বুথ লেভল অফিসার (বিএলও)-এর ঝুলন্ত দেহ উদ্ধারের ঘটনায় পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে চায় না পরিবার। নদিয়ার কৃষ্ণনগরের ওই বিএলও রিঙ্কু তরফদারের স্বামী আশিস তরফদারের কথায়, ‘‘নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কমিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আমরা কি পারব!” পুলিশেরও দাবি, এ ভাবে সরাসরি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এফআইআর করা যায় না। মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়তো সম্ভব। তবে যদি ‘সুইসাইড নোট’ রিঙ্কু তরফদারের লেখাও হয়, তাতে কারও নাম নেই।
এ দিনই রাজ্যের আরও অন্তত তিন জায়গায় কাজের চাপে বিএলও-র অসুস্থ হয়ে পড়ার অভিযোগ উঠেছে। উত্তর ২৪ পরগনার ন্যাজাটে এক বিএলও-কে খুনের হুমকি দেওয়ার অভিযোগে এক তৃণমূল নেতাকে শনিবার রাতে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সাসপেন্ড হওয়া জেলবন্দি নেতা শেখ শাহজাহানের ‘আস্থাভাজন’ বলে এলাকায় পরিচিত জামিরুল ইসলাম মোল্লা নামে ওইতৃণমূল নেতা।
কৃষ্ণনগরের বিএলও রিঙ্কুর পরিবারের দাবি, তিনি গোড়া থেকেই দুশ্চিন্তায় ভুগছিলেন। কাজে তাঁকে সহযোগিতা করছিলেন এক আত্মীয়, পাশের বুথের বিএলও সুশান্ত বিশ্বাস। তিনি জানান, রিঙ্কু শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ ফোন করে তথ্য আপলোডের বিষয়ে কথা বলেন। কাজ শেষ করা নিয়ে উদ্বেগ জানান। সুশান্তের দাবি, রাত পৌনে ১২টা নাগাদও তাঁকে ফোন করেছিলেন রিঙ্কু। কিন্তু তিনি ঘুমিয়ে পড়ায়, কথা হয়নি। তাঁর বাড়িতেই রিঙ্কুর গণনাপত্রগুলি রাখা থাকত। ফোনে না পেয়ে রিঙ্কু মোবাইল-বার্তায় জানিয়েছিলেন, ফর্মে তাঁর সইয়ের সঙ্গে সিল মারা হয়নি। তিনি যেন বিষয়টা দেখে নেন।
রিঙ্কুর মৃত্যুর পরে নানা রাজনৈতিক দল পরিবারের সঙ্গে দেখা করলেও, বিজেপির কোনও নেতা-মন্ত্রী তাঁর বাড়িতে যাননি। বিজেপির নদিয়া উত্তর সাংগঠনিক জেলা সভাপতি অর্জুন বিশ্বাস বলেন, “শনিবার আমি জেলায় ছিলাম না। তবে ফোনে পরিবারের সঙ্গে কথা হয়েছে। শীঘ্রই দেখা করতে যাব।”
সন্দেশখালির বয়ারমারি ১ অঞ্চলের বিএলও দীপক মাহাতোর বাড়িঘর ভেঙে খুনের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের অঞ্চল সম্পাদক জামিরুল ইসলাম মোল্লার বিরুদ্ধে। বিএলও-র অভিযোগ, “বেশ কিছু মৃত ভোটারের নাম বাদ দেওয়ায় বেজায় রেগে যান ওই তৃণমূল নেতা। মেরে ফেলার ভয় দেখান।” জামিরুল এ নিয়ে মন্তব্য করেননি। তৃণমূলের অভিযোগ, এটা বিজেপির চক্রান্ত। বিজেপির পাল্টা দাবি, ভয় দেখিয়ে ভুয়ো ভোটার রাখা হচ্ছে তালিকায়।
রবিবার সকালে মছলন্দপুরের বিএলও সুমনকুমার দাস বাড়িতে অনলাইনে গণনাপত্র আপলোডের সময়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন বলে জানায় পরিবার। তাদের দাবি, তাঁর শরীরের বাঁ দিক আংশিক নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছে। ভর্তি করানো হয়েছে হাবড়া স্টেট জেনারেল হাসপাতালে। তাঁর ভাই অয়ন দাসের দাবি, “প্রায় চারশো ফর্ম জমা পড়ে যাওয়ায়, সেগুলি রাতের মধ্যেই নির্বাচন কমিশনের নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে আপলোড করতে হত। প্রতিটি ফর্ম আপলোডে ১৫-২০ মিনিট সময় লাগত। প্রায়ই সার্ভারের সমস্যায় কাজ দীর্ঘায়িত হচ্ছিল। এই চাপ সামলাতে গিয়ে দাদা মানসিক অবসাদে ভুগছিল।” হাসপাতাল সূত্রের দাবি, বিএলও উচ্চ রক্তচাপের রোগী, আগে হৃদ্রোগে আক্রান্তও হয়েছেন। শ্বাসকষ্টের সমস্যার জন্য দিনে দু’বার ইনহেলার নিতে হয়। এ দিন সকালে তা নিতে ভুলেছিলেন। খাবার খাননি। তাই অসুস্থ হয়ে পড়েন।
কাটোয়ার এক বিএলও শুকদেব দাস রবিবার রক্তচাপ কমে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ায় হাসপাতালে ভর্তি হন। তাঁর দাবি, “কয়েক রাত ঘুমোইনি। লক্ষ্যপূরণে পিছিয়ে যাওয়ার উদ্বেগ কাজ করছিল।” মহকুমাশাসক (কাটোয়া) অনির্বাণ বসু বলেন, “কোনও চাপ দেওয়া হয়নি।” বহরমপুরের বানজেটিয়ার বিএলও অসীমকুমার ঘোষকে শনিবার রাতে এলাকার এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। বিএলও-র স্ত্রী রত্না ঘোষের বক্তব্য, “স্বামী উচ্চ রক্তচাপের রোগী। এসআইআরের কাজের জন্য মানসিক চাপ বেড়েছে। তা সহ্য করতে না পেরে মাথা ঘুরে পড়ে যান।” বিডিও (বহরমপুর) অমরজ্যোতি সরকারের দাবি, “উনি শৌচালয়ে পড়ে গিয়ে অসুস্থ বোধ করেন।”
বীরভূমের সাঁইথিয়ার মাঠপলশায় বোনের বিয়ের মণ্ডপেই এ দিন এসআইআরের কাজ করতে দেখা যায় বিএলও নিসার আহম্মদকে। তিনি বলেন, “গ্রামে ইন্টারনেট সংযোগের সমস্যা রয়েছে। কাজে অসুবিধা হচ্ছে। হাতে সময় বেশি নেই। তাই বিয়ের অনুষ্ঠানের ফাঁকে কাজ করতে হচ্ছে।”
কাজের চাপ কাটাতে ক্রিকেট ব্যাট হাতে মাঠে নামেন পূর্ব মেদিনীপুরের দুই বিএলও সুতাহাটার সন্দীপন দাস এবং চন্দন জানা। হলদিয়ায় রবিবার ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় ৩৩ বলে ৭১ রান করে ম্যাচের সেরা হন সন্দীপন। তিনি বলেন, “দমবন্ধ করা চাপ কাটাতে খেলতে নেমেছি।”
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)