Advertisement
E-Paper

আলুচাষির আত্মহত্যা আসলে ষড়যন্ত্র বিরোধীদের, বালুরঘাটে বললেন মন্ত্রী

রানাঘাটে বৃদ্ধা সন্ন্যাসিনীর ধর্ষণের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ, হুগলি-বর্ধমানে আলুচাষির আত্মহত্যা, এ দুটিতে মিল কোথায়? উত্তর সহজ। দুটোই “বিরোধী ষড়যন্ত্র” বলে মনে করছে সরকার। রানাঘাটে জনরোষের মুখে পড়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, বিজেপি-সিপিএম বিক্ষোভ করাচ্ছে। আর গোটা রাজ্যে আলুচাষি যখন চরম বিপর্যস্ত, তখনই মালদহের গাজলে কৃষি বিপণন মন্ত্রী অরূপ রায় বললেন, “গ্রামের কোনও মানুষ মারা গেলে তাঁকে কৃষক বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা বিরোধীদের ষড়যন্ত্র।”

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০১৫ ০৪:১২
দাম মিলছে না। খেত থেকে তোলা আলু মাঠেই পড়ে।—নিজস্ব চিত্র।

দাম মিলছে না। খেত থেকে তোলা আলু মাঠেই পড়ে।—নিজস্ব চিত্র।

রানাঘাটে বৃদ্ধা সন্ন্যাসিনীর ধর্ষণের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ, হুগলি-বর্ধমানে আলুচাষির আত্মহত্যা, এ দুটিতে মিল কোথায়?

উত্তর সহজ। দুটোই “বিরোধী ষড়যন্ত্র” বলে মনে করছে সরকার। রানাঘাটে জনরোষের মুখে পড়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, বিজেপি-সিপিএম বিক্ষোভ করাচ্ছে। আর গোটা রাজ্যে আলুচাষি যখন চরম বিপর্যস্ত, তখনই মালদহের গাজলে কৃষি বিপণন মন্ত্রী অরূপ রায় বললেন, “গ্রামের কোনও মানুষ মারা গেলে তাঁকে কৃষক বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা বিরোধীদের ষড়যন্ত্র।”

বুধবার গাজলের কৃষক বাজার পরিদর্শন করে বালুরঘাটে সরকারি অনুষ্ঠানে যোগ দেন অরূপবাবু। ভুয়ো প্রচার করে বিরোধীরা যে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা করছে, তার উদাহরণ দিয়ে মন্ত্রী বলেন, “সম্প্রতি হুগলিতে স্বপন কণ্ডুু নামে এক কৃষক আত্মঘাতী হন। তার দুই ছেলে চাকরি করেন। দোতলা বাড়ি। ব্যক্তিগত কারণে স্বপনবাবু আত্মহত্যা করেছেন। অথচ আলুর দাম না পেয়ে তিনি আত্মঘাতী হন বলে প্রচার করা হল।”

খানাকুলের কেটেদলের বাসিন্দা স্বপনবাবুর (৫৫) স্ত্রী শিখা পুলিশকে জানিয়েছিলেন, দীর্ঘ অসুস্থতা এবং আলুর দাম না পাওয়ায় তাঁর স্বামী ভেঙে পড়েছিলেন। কী ভাবে সংসার চলবে, তা নিয়ে হা-হুতাশ করতেন। স্বপনবাবু যে বাস্তবিকই আলুচাষ করে ঋ

ণগ্রস্ত হন, তা জানালেন কেটেদল সমবায় কৃষি উন্নয়ন সমিতির সমীর মণ্ডল। সমীরবাবু জানান, আলুচাষের জন্য স্বপনবাবু ওই সমবায় থেকে ৭৪ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন।

হুগলিতেই আরও এক চাষি আত্মঘাতী হন। তাঁর দেহ পাওয়া যায় নিজেরই জমির কোণে রাখা আলুর গাদার পাশে। ১৫ মার্চ আরামবাগের আরান্ডি ২ পঞ্চায়েতের রায়পুর গ্রামের মাঠপাড়ার আলু চাষি তপন জানার মৃতদেহ উদ্ধার হওয়ার পর তপনবাবুর স্ত্রী পূর্ণিমা জানা পুলিশকে বলেন, তাঁর সোনার গয়না বন্ধক দিয়ে তিন বিঘা জমিতে আলু চাষ করেন তপনবাবু। ওই জমির মধ্যে দেড় বিঘা নিজেদের। বাকি দেড় বিঘা লিজে। পূর্ণিমাদেবীরও বক্তব্য, “আলুর দাম না থাকায় স্বামী ভেঙে পড়েছিলেন। গয়না ছাড়ানো যাবে না বলে দুশ্চিন্তা করতেন। গয়না নিয়ে মনোমালিন্যের পরে ওই ঘটনা ঘটান।” পূর্ণিমাদেবী বলেন, “কেউ যদি বলেন, আলুচাষের সঙ্গে স্বামীর মৃত্যুর সম্পর্ক নেই, সেটা ঠিক নয়।” আরামবাগের তৃণমূল নেতা সোহরাব হোসেনও বলেন, “তপনবাবু আলুচাষ করতেন। বিক্রিবাটা হয়নি। দেনার কারণেই তিনি আত্মঘাতী হয়েছেন।”

পুলিশ-প্রশাসনের রিপোর্টে কিন্তু পরিবার-প্রতিবেশীর বয়ান স্থান পায়নি। আরামবাগ মহকুমাশাসক প্রতুলকুমার বসু বলেন, “সরেজমিনে তদন্তের পর দু’টি ক্ষেত্রেই আমরা মনে করি না মৃত্যুর সঙ্গে আলুচাষের যোগ আছে।” কেন এই সিদ্ধান্ত? প্রতুলবাবুর বক্তব্য, স্বপনবাবুর আর্থিক অবস্থা এমন নয় যে, তিনি সমবায়ের ঋণ শোধ করতে পারতেন না। আর তপনবাবু নিজেই টাকা ধার দিতেন চাষিদের। সেই টাকা না পেয়ে স্ত্রীর গয়না বন্ধক রেখেছিলেন। তা নিয়ে মনোমালিন্যের জেরে আত্মহত্যা।

যে ৯টি আত্মহত্যা এখনও অবধি হয়েছে, তার প্রতিটিতেই একই নকশা স্পষ্ট। পরিবার পুলিশকে বলছে, আলুচাষে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চরম পথ বেছে নিয়েছেন চাষি। আর জেলা প্রশাসন রিপোর্ট দিয়েছে, অসুস্থতা, অবসাদ কিংবা পারিবারিক অশান্তির জেরে আত্মহত্যা করেছে চাষি। বাম জমানাতেও প্রশাসন কখনও ক্ষতিগ্রস্ত চাষির আত্মহত্যা দেখতে পায়নি। এই জমানাতেও পাচ্ছে না।

কখনও কৃষক পরিচয় নিয়েই হচ্ছে টানাটানি। ১৪ মার্চ, শনিবার কালনা-১ সিমলন গ্রামের কোড়াপাড়ার আলুচাষি কৃষ্ণ সর্দারের ঝুলন্ত দেহ মেলে। স্ত্রী পূর্ণিমাদেবী বলেন, “স্বামী সাত কাঠা জমিতে আলু চাষ করেছিলেন। তার মধ্যে তিন কাঠা নিজেদের। বড় মেয়ের বিয়েতে কিছু দেনা হয়েছিল। স্বামী ভেবেছিলেন, আলু বিক্রির টাকায় তা শুধবেন। কিন্তু আলুতে দাম মেলেনি। অবসাদগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করেন।” বর্ধমানের জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন অবশ্য বলেন, “কালনার কৃষ্ণ সর্দার খেতমজুরির কাজ করতেন। তাঁর জমি ছিল না।” তিনি পারিবারিক অশান্তি ও মানসিক অশান্তির জেরে আত্মঘাতী হন বলে দাবি জেলা শাসকের।

গলসির সাঁকো পঞ্চায়েত এলাকার বাসিন্দা গণেশ সরেন (২৫) কীটনাশক খেয়ে আত্মঘাতী হন। তাঁর দাদা ছোট্টু সরেন দাবি করেন, “ভাই পাঁচ বিঘে জমিতে ভাগ চাষ করেছিল। তাতেও মহাজনের কাছে অনেক টাকা ধার করতে হয়। প্রথমে নাবি ধসায় আলুর খারাপ ফলন, পরে আবার দামও না মেলায় হতাশায় ভুগছিল। দেনা শোধ করার চাপে কীটনাশক খায় ভাই।” জেলাশাসকের দাবি, “গলসির গণেশ আলুচাষি ছিলেন না। তিনি বাড়িতে ঝামেলায় বিষে আত্মঘাতী হন।” কৃষ্ণ সর্দার বা গণেশ সরেনের মতো যে চাষিদের নিজের জমি নেই, খাতায়কলমে তাঁরা ‘কৃষক’ নন, খেত মজুর। অথচ কার্যত এঁরা অধিকাংশই অন্যের জমি লিজ নিয়ে, চড়া সুদে ধার নিয়ে চাষ করেন। প্রাক্তন ভূমি ও ভূমি সংস্কার মন্ত্রী রেজ্জাক মোল্লা বলেন, “চাষি, চাষির বউ পর্যন্ত মারা যাচ্ছে। অথচ সরকার বলছে, এরা চাষি নন। তা হলে এঁরা কি ডাক্তার, নাকি প্রফেসর?” তিনি জানান, নির্দিষ্ট রফতানি নীতি নেই, হিমঘরে জায়গা নেই, বন্ডে দুর্নীতি, এসব চাষিদের দুর্দশার জন্য দায়ী।

আলু কেনা নিয়ে ক্ষোভ

বুধবারেও হুগলির সর্বত্র আলু কেনা শুরু করতে পারেনি প্রশাসন। এ দিন আরামবাগ মহকুমার ৬টি ব্লকে আলু কেনা হয়। প্রশাসন সূত্রের দাবি, ১১০ টনের বেশি আলু কেনা হয়।” পোলবা-দাদপুর ব্লকেও আলু কেনা শুরু হয়েছে। তবে জেলার কৃষক সংগঠনগুলি তেমন আশার আলো দেখছে না। সিপিএমের কৃষক সভার নেতা উত্তম সামন্ত বলেন, “সব চাষির আলু কেনার পরিকাঠামো কই সরকারের?” বর্ধমানে মেমারির চাষি অলোক মাঝির প্রশ্ন, “এক একটি ব্লক থেকে প্রথম পর্যায়ে ৮০০-১০০০ বস্তা আলু কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেই অনুযায়ী পঞ্চায়েতগুলির ভাগে পড়েছে গড়ে ১০০ বস্তা। এতে আর কতটা সুরাহা হবে?” মেমারির আর এক চাষি সঞ্জিত মজুমদারের বক্তব্য, “প্রচার হল রাজ্য সরকার সহায়ক মূল্যে আলু কিনল। অথচ, চাষিদের কার্যত কোনও লাভ হল না।”

potato farmer suicide
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy