Advertisement
E-Paper

কাঁদায়, কিন্তু চাষির আশা জিইয়ে রাখে সেই আলুই

ফলন ভাল হোক বা খারাপ— ফি বছর আলু চাষ করা থেকে নড়তে নারাজ এ রাজ্যের কৃষিজীবীদের একটা বড় অংশ। কয়েক বছর অন্তর-অন্তর আলুচাষ বিপুল ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এ রাজ্যে। আত্মহত্যার খবর মেলে নানা জেলা থেকে। গত দেড় দশকে অন্তত ছ’বার আলু চাষে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। বিপুল পরিমাণ আলু মাঠে পড়ে পচছে, এ দৃশ্য দেখেননি এমন চাষি রাজ্যে নেই বললেই চলে।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৫ ০৩:০৪

ফলন ভাল হোক বা খারাপ— ফি বছর আলু চাষ করা থেকে নড়তে নারাজ এ রাজ্যের কৃষিজীবীদের একটা বড় অংশ। কয়েক বছর অন্তর-অন্তর আলুচাষ বিপুল ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এ রাজ্যে। আত্মহত্যার খবর মেলে নানা জেলা থেকে। গত দেড় দশকে অন্তত ছ’বার আলু চাষে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। বিপুল পরিমাণ আলু মাঠে পড়ে পচছে, এ দৃশ্য দেখেননি এমন চাষি রাজ্যে নেই বললেই চলে। তার পরেও এই ঝুঁকির পথ ছাড়তে নারাজ কৃষিজীবীরা।

চাষিদের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেল, এ হল ফাটকা খেলার ঝোঁক। হুগলির পুড়শুড়ার জঙ্গলপাড়ার নির্মল মাইতি বললেন, “আমরা জানি, আলু দিলে ছপ্পর ফুঁড়ে দেবে, না হলে মারবে। তাই ঝুঁকি তো নিতেই হবে।” বর্ধমানের কালনা ২ ব্লকের আলুচাষি তপন ঘোষের কথায়, “আলুর বাজার অনেকটাই ফাটকা। বহু বার অন্য রাজ্যে বিপর্যয়ের কারণে এ রাজ্যে দাম বেড়ে গিয়েছে। তখন ভাল দাম মিলেছে।” তা ছাড়া, এক বছরের লোকসান পুষিয়ে গিয়েও লাভ থাকে অন্য বছরে। পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুর ১ ব্লকের সুজিত দোলই, গোষ্ঠবিহারী মূলাদের বক্তব্য, “দু-তিন বছরে যা লাভ হয়, তাতে এক বছরের লোকসান পুষিয়ে যায়। তাই সব জেনেও আলু চাষ ছাড়তে পারি না।”

ধরা যাক, গোঘাটের দেবীপ্রসাদ গুঁইয়ের কথা। তিনি ৩০ বছর ধরে চার বিঘা জমিতে আলু চাষ করে আসছেন। গত বছর বিঘা-পিছু লাভ ছিল ১৬ হাজার টাকা। এ বার বিঘা-পিছু সাত হাজার টাকা লোকসান হয়েছে। লাভ-লোকসানের এই চক্রের সঙ্গে তিনি ভালই পরিচিত। তবু বিকল্প চাষের দিকে তাঁর ঝোঁক নেই। কেন?

দেবীপ্রসাদবাবু বললেন, “বিকল্প বলতে আলুর সময়ে খালি সর্ষে করা যেতে পারে। খুব ভাল ফলন হলেও বিঘায় দু’কুইন্টাল সর্ষে হবে। তাতে বিঘায় দু’হাজার টাকার বেশি লাভ পাওয়া যায় না। তার চেয়ে লটারির মতো আলু চাষই ভাল।”

এই লটারি জেতার ঝোঁকেই চাহিদা-জোগানের হিসেব ভুলে আরও বেশি আলু উৎপাদনে নেমে পড়েন চাষিরা। ফলে, রাজ্যের চাহিদা ছাপিয়ে বিপুল উদ্বৃত্ত থেকে যায়। ধূপগুড়ির তপন দত্ত গতবার ৭০ বিঘা জমিতে আলু চাষ করে ৯ লক্ষ টাকা লাভ করায়, এ বারে ১০০ বিঘায় চাষ করেছেন। স্পষ্টই বললেন, “আলু চাষ জুয়ার নেশার মতো। দাম না মিললে কী হবে, তা ঈশ্বর জানেন।”

চাষিদের দাবি, বিকল্প চাষের সমস্যাও আছে। তিল, সর্ষের মতো ফসলের বাজার খুঁজে পেতে হিমশিম খেতে হয় অনেক ছোট চাষিকে। বাঁকুড়ার কোতুলপুরের অমূল্য সরকার যেমন জানালেন, বাদাম, ভুট্টা লাগিয়ে খদ্দের মেলেনি তাঁর, তাই এ বছর ছ’বিঘা জমিতেই আলু চাষ করেছেন। গড়বেতা-২ ও ৩ ব্লকের কড়সা, সাতবাঁকুড়া, পাথরপাড়া পঞ্চায়েতের আলু চাষি রবি ঘোষ, স্বপন মণ্ডলেরা বলেন, “কৃষি দফতরের পরামর্শ অনুযায়ী আলু চাষের সঙ্গে অন্য জমিতে মুগ ও মসুর চাষ করেছিলাম। ওই সব ফসল চাষে খরচ কম, এটা ঠিক। কিন্তু বাজারে চাহিদা ভাল থাকলে আলু চাষে যে লাভ পাওয়া যায়, তা অন্য কোনও চাষে নেই। তাই প্রতি বছরই আলুর মরসুমের দিকেই আমরা তাকিয়ে থাকি।”

চাষিদের আর এক যুক্তি পেঁয়াজ, সব্জি, মাঠেই বিক্রি করে দিতে হয়, যে দামই মিলুক না কেন। কিন্তু ছোট বা মাঝারি চাষিও হিমঘরে আলু রেখে ভাল দাম পেয়েছেন অনেক বার। আলু বন্ড বাঁধা রেখে ঋণও পাওয়া যায়। “দীর্ঘ সময় আলু নিয়ে বাজি লড়া যায়,” বলছেন চাষিরা। তাই সরকার বিনামূল্যে পেঁয়াজের বীজ, বা বিকল্প চাষে ভর্তুকি, প্রশিক্ষণ দিলেও তাতে তেমন আগ্রহী হন না চাষিরা।

গরিষ্ঠ সংখ্যক কৃষিজীবীর বক্তব্য, আলু চাষের পদ্ধতি সহজ। গ্রামগঞ্জে পরিবারের অনেকেই এই চাষে রপ্ত। ফলে, মরসুমে খেতমজুর কম সংখ্যায় বা পাওয়া না গেলেও সমস্যা হয় না। পরিবারের লোকেরাই চাষ দেখভাল করতে পারেন। চাষের অভ্যাসও চাষির কাছে একটা বড় কথা। কালনার চাষি পরেশ সমাদ্দার বললেন, “বাপ-ঠাকুরদার আমল থেকে দেখে আসছি, বর্ধমানের মাটিতে আলুর কোনও বিকল্প নেই। কখনও কখনও সূর্যমুখীর মতো কিছু বিকল্প চাষের চেষ্টা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা আলুর জায়গা নিতে পারেনি। আলু কাঁদায় কিন্তু আলু-ই চাষির আশা জিইয়ে রাখে।”

প্রশাসনের একটা অংশের বক্তব্য, অনেক ক্ষেত্রেই লাভের আশায় চড়া সুদে ধার নিয়ে চাষ করছেন চাষি। সেই ফাটকায় বিপর্যয় হলে ক্ষতি সামাল দিতে সরকার কেন আলু কিনবে? সরকারের ভরসায় চাষ করা কেন? চাষিদের দাবি, সরকারের ভরসায় তাঁরা আলু চাষ করেন না। তা হলে বাজারে ক্ষতি হলে সরকারি সহায়ক মূল্যে আলু কেনা দাবি তুলছেন কেন? চাষিরা বলছেন, যে পরিমাণ আলু সরকার কিনতে পারবে, তাতে চাষির ক্ষতি প্রায় কিছুই কমবে না, সেটা তাঁরা ভালই জানেন। আরামবাগের এক চাষির স্বীকারোক্তি, “তবু সাহায্যের দাবিটা করে থাকি। হলে হল, না হলে না হল। যদি সমবায়ের ঋণটা কিছুটা মকুব হয়, খারাপ কী?”

potato farmer Hoogly Farmer Birbhum subsidised price Kalna State government
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy