Advertisement
০৫ মে ২০২৪
অভিযুক্তের পাশে মন্ত্রী

মেয়ের ধর্ষণ রুখতে গিয়ে মার খেলেন বৃদ্ধ

হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন বৃদ্ধ। চোখ ব্যান্ডেজে প্রায় ঢেকে গিয়েছে। তার নীচ থেকে জলের ধারা নেমে এলো অঝোরে। যে দুষ্কৃতী তাঁর বিধবা মেয়েকে একাধিক বার ধর্ষণ করতে চেয়েছে, যাকে বাধা দিতে গিয়ে চোখে রডের মর্মান্তিক আঘাত পেয়ে তিনি শয্যাশায়ী, টিভিতে সেই অভিযুক্তকেই সমর্থন করছেন জেলার মন্ত্রী, কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী।

নিজস্ব সংবাদদাতা
মালদহ শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:০১
Share: Save:

হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন বৃদ্ধ। চোখ ব্যান্ডেজে প্রায় ঢেকে গিয়েছে। তার নীচ থেকে জলের ধারা নেমে এলো অঝোরে। যে দুষ্কৃতী তাঁর বিধবা মেয়েকে একাধিক বার ধর্ষণ করতে চেয়েছে, যাকে বাধা দিতে গিয়ে চোখে রডের মর্মান্তিক আঘাত পেয়ে তিনি শয্যাশায়ী, টিভিতে সেই অভিযুক্তকেই সমর্থন করছেন জেলার মন্ত্রী, কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী। এবং সন্দেহ প্রকাশ করেছেন তাঁর মেয়ের চরিত্র নিয়েই। “নানা জায়গা থেকে মদত পেয়েই এখন রিন্টুদের বাড়বাড়ন্ত,” বলেন ওই বৃদ্ধ। অভিযুক্ত রিন্টু শেখ পলাতক।

কী বলেছেন কৃষ্ণেন্দু? রাজ্যের খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ এবং উদ্যানপালন মন্ত্রীর বক্তব্য, “ধর্ষণের চেষ্টার কোনও ঘটনাই ঘটেনি। অভিযোগকারিণীর সঙ্গে অভিযুক্ত যুবকের অবৈধ সম্পর্ক ছিল। তাই স্বেচ্ছা-সহবাসকে কখনওই ধর্ষণ বলা যাবে না।” তাঁর দাবি, এই সম্পর্কের কথা জেনে ফেলায় বাবা বাধা দিতে যান। তখনই ওই যুবকটি হামলা চালায়।

প্রশ্ন উঠেছে, পুলিশ তদন্ত শুরু করার আগেই কী করে মন্ত্রী এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেলেন? এবং সেই সূত্র ধরে অনেকেই বলছেন, পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডের পর আক্রান্ত মহিলার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিব্রত হয়েছিলেন তৃণমূল সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদার। ফের কেন এক তৃণমূল নেতা গোড়াতেই আক্রান্ত মহিলার দিকে আঙুল তুললেন?

এ প্রশ্নের জবাবে মালদহেরই অন্য তৃণমূল মন্ত্রী সাবিত্রী মিত্র বলেন, “কে কী বলেছে জানি না। তবে গ্রাম্য সালিশি করার অধিকার কারও নেই। পুলিশকে বলেছি অভিযোগ অনুসারে ব্যবস্থা নিতে।”

কিন্তু পুলিশ কি আদৌ ব্যবস্থা নেবে এই প্রশ্ন তুলেছেন এলাকার অনেকেই। মালদহের ইংরেজবাজারের বাসিন্দা ওই বৃদ্ধ আর তাঁর বিধবা কন্যা তাঁদের উপর ক্রমাগত হামলার যে বিবরণ এ দিন প্রকাশ্যে জানিয়েছেন, তাতে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। বিশেষ করে বিষয়টি মিটিয়ে নিতে যখন খোদ থানাতেই হয়েছে সালিশি সভা! এই পুরো ঘটনায় তাই শুধু পার্ক স্ট্রিটই নয়, উঠে এসেছে মধ্যমগ্রাম থেকে ধূপগুড়ি, তৃণমূল আমলে ঘটা বহু ঘটনারই তুলনা। শাসক দলের মদতে দুষ্কৃতীর যৌন নির্যাতন, পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা, খোদ থানার মধ্যে বসে তৃণমূল নেতাদের সালিশি, দুষ্কৃতীর হুমকি এবং ফের ধর্ষণের চেষ্টা পড়েছে সব রকম ছায়াই।

এ দিন হাসপাতালে ওই বৃদ্ধ অভিযোগ করেন, আতঙ্কের দিনের শুরু চার মাস আগে। সেই সময়ে পুকুরিয়ার রিন্টু শেখ তাঁদের বাড়িতে চড়াও হয়ে তাঁর মেয়েকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। তিনি বলেন, “সে যাত্রায় আমি টের পেয়ে হইচই করলে লোকজন ছুটে আসে।” তাঁর বক্তব্য, তখন থানায় গেলে সালিশি সভার পরামর্শ দেয় পুলিশ। তার পর থানাতেই সালিশি করে টাকা আদায় করা হয়। পুলিশ রিন্টুকে ধরেনি। ওই বৃদ্ধের অভিযোগ, “এর পর থেকে রিন্টু বারেবারেই অভিযোগ তুলে নিতে হুমকি দিচ্ছিল। তাতে রাজি হইনি। বেপরোয়া হয়ে ফের সোমবার রাতে চড়াও হয়েছিল ও। আমি এবং মেয়ে মিলে বাধা দিই। তখন রড দিয়ে আমাকে মেরে পালিয়ে যায়।”

ওই মহিলার স্বামী পাঁচ বছর আগে মারা গিয়েছেন। দুই মেয়েকে নিয়ে তিনি বাবার কাছেই থাকেন। এ দিনই তিনি পুকুরিয়া থানায় বসে দাবি করেছেন, গত ৯ জুলাই পুকুরিয়া থানায় রিন্টুর বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে যান তিনি। তাঁর বক্তব্য, “পুলিশ সালিশি সভা বসিয়ে মীমাংসার পরামর্শ দিয়েছিল। সালিশি সভায় অভিযুক্তের ১০ হাজার টাকা জরিমান করা হয়েছিল। সালিশি সভার মাতব্বরেরা সেই টাকা রিন্টু শেখের কাছে থেকে আদায় করলেও আমাকে একটি টাকাও দেননি।”

সেই সভায় যে মীমাংসাপত্র সই হয়েছিল, সেটিও প্রমাণ হিসেবে দাখিল করেছেন তিনি। সেখানে সাক্ষী হিসেবে সই করেছেন স্থানীয় তৃণমূল নেতা রাজকুমার চৌধুরী। সই করেছেন শেখ সায়েদ, জবান চৌধুরী, তানু শেখ এবং মতিজুর শেখ, যাঁরা কংগ্রেসকর্মী বলে পরিচিত। মীমাংসাপত্রের বয়ানে বলা হয়, “আমরা বাদী ও বিবাদী উভয়ে সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তির সামনে বসিয়া শান্ত ও সুষ্ঠু আপস মীমাংসা করিয়া লইলাম।” কী সেই মীমাংসা? “আমরা বিবাদীপক্ষ... বাদীর প্রতি কোনও দিন অন্যায় বাক্যপ্রয়োগ, তাহার যাতায়াতে বাধা বিঘ্ন এবং তাহার বাড়িতে গিয়ে অপদস্থ করিব না।” মোড়লদের কাছে অভিযুক্ত ১০ হাজার টাকা জমা দেবে বলেও ওই সালিশির অঙ্গীকার পত্রে বলা হয়েছে।

কিন্তু রিন্টু শেখ সংযত হয়নি। সে বারবার পুলিশে দায়ের করা অভিযোগ তুলে নিতে চাপ দেয়, উত্ত্যক্ত করতে থাকে মেয়েটিকে। সোমবার রাতে ফের ধর্ষণের চেষ্টা চালালে মেয়েটিকে বাঁচাতে গিয়ে তাঁর বাবা আক্রান্ত হন।

ইংরেজবাজার থানার যেখানে ওই মহিলার বাড়ি, তার অদূরেই একটি বেআইনি মদের ভাটি রয়েছে। সেখানে পুকুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা রিন্টু নিয়মিত যাতায়াত করে বলে বাসিন্দাদের অভিযোগ। গুন্ডা বলে পরিচিত সে। ওই এলাকার গ্রাম পঞ্চায়েত তৃণমূলের দখলে। রিন্টুর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পরে কিছু তৃণমূল নেতা সালিশি সভায় হাজির হন। তাঁদের একাংশের মদতে রিন্টু বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কি না, তা নিয়েও তদন্তের দাবি ওঠে।

পুলিশ ধর্ষণের অভিযোগ পেয়েও রিন্টুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে সালিশির পরামর্শ দিল কেন? পুকুরিয়া থানার ওসি প্রদীপ সরকার বিষয়টি অস্বীকার করছেন। তাঁর দাবি, “চার মাস আগে কোনও মহিলা ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগ করেনি। সালিশির পরামর্শও দেওয়া হয়নি।” সালিশি সভার মীমাংসা ও চুক্তিপত্র থানায় জমা দেওয়া হয়েছিল বলে জানিয়েছেন আক্রান্ত মহিলা। তৃণমূল নেতা রাজকুমার চৌধুরীও বলেন, “গত ৯ জুলাই থানায় দু’পক্ষের মধ্যে মীমাংসা হয়েছিল। আমরা চুক্তিপত্রের প্রতিলিপি ওসি প্রদীপবাবুকে দিয়ে আসি।”

এসপি প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “খোঁজ নিয়ে দেখেছি, এমন কিছু ঘটেনি। ঘটে থাকলে অভিযুক্ত পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” অভিযোগ যাচাইয়ে এএসপি এ দিন ইংরেজবাজার গিয়ে বিধবা মহিলাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। পুলিশ তাঁর বয়ান ভিডিও করেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

maldah rape krishnendu narayan chowdhury rintu sekh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE