E-Paper

রহস্যের পূর্ণ উদ্ধার হল কই, প্রশ্ন ঘুরছে কমিটি রিপোর্টের পরেও

মুর্শিদাবাদে অশান্তির ঘটনার পরে সামনে আসা স্থানীয় বাসিন্দাদের এই সব অভিযোগই লিপিবদ্ধ হয়েছে কলকাতা হাই কোর্টের নিযুক্ত তিন সদস্যের তথ্যানুসন্ধান কমিটির রিপোর্টে।

সন্দীপন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০২৫ ০৬:০৫
মুর্শিদাবাদে অশান্তির সময় যৌথবাহিনীর টহল।

মুর্শিদাবাদে অশান্তির সময় যৌথবাহিনীর টহল। —ফাইল চিত্র।

পুলিশ সময়ে আসেনি। দুষ্কৃতীরা অবাধে তাণ্ডব চালিয়েছে। আগুন নেভানোর জন্য জল পর্যন্ত মেলেনি। বাড়ি-ঘর ভাঙচুর হয়েছে, লুট হয়েছে। কারও জমানো টাকা, কারও গয়না খোয়াতে হয়েছে। আর তারই পাশাপাশি নৃশংস ভাবে খুন হয়েছেন বাবা-ছেলে।

মুর্শিদাবাদে অশান্তির ঘটনার পরে সামনে আসা স্থানীয় বাসিন্দাদের এই সব অভিযোগই লিপিবদ্ধ হয়েছে কলকাতা হাই কোর্টের নিযুক্ত তিন সদস্যের তথ্যানুসন্ধান কমিটির রিপোর্টে। যাকে হাতিয়ার করে আসরে নেমে গিয়েছে বিজেপি। কিন্তু কেন্দ্রের সংশোধিত ওয়াকফ আইনের প্রতিবাদকে উপলক্ষ করে মুর্শিদাবাদ জেলার উত্তরাংশে গত এপ্রিল মাসের কয়েক দিন ধরে যে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে, তার পূর্ণাঙ্গ ছবি এই তথ্যানুসন্ধান কমিটির রিপোর্টে উঠে এসেছে কি? মোট ১৩ পাতার রিপোর্ট ঘাঁটলে সব প্রশ্নের উত্তর মিলছে না। আক্রান্ত এলাকার একাংশের বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, তাঁদের অভিযোগ শুনতে কেউ যায়নি। এমন রিপোর্টকে ‘আংশিক সত্য’ আখ্যা দিয়ে সরাসরি বিচারবিভাগীয় তত্ত্বাবধানে তদন্ত এবং দোষীদের কড়া শাস্তি দাবি করছেন দুই বিরোধী দল সিপিএম এবং কংগ্রেসের নেতৃত্ব।

গোলমালের ঘটনার পরে পুলিশ-প্রশাসনের ব্যর্থতার অভিযোগ করে এবং কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের আর্জি নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। হাই কোর্ট কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিন সদস্যের কমিটি গড়ে দিয়েছিল তথ্য উদ্ঘাটনের জন্য। সেই মতো জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের রেজিস্ট্রার (আইন) যোগেন্দ্র সিংহ, ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল লিগ্যাল সার্ভিসেস অথরিটি’র সদস্য-সচিব সত্য অর্ণব ঘোষাল এবং হাই কোর্টের রেজিস্ট্রার (ডব্লিউবিজেএস) সৌগত চক্রবর্তী মুর্শিদাবাদের হিংসা কবলিত কিছু এলাকায় ঘুরে আক্রান্ত বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁদের রিপোর্টে সেই বাসিন্দাদের ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ, তাঁদের অভিযোগ, পুলিশের ভূমিকার বিশদে উল্লেখ রয়েছে। যেমন, বেতবোনায় ১১৩টি বাড়িতে ভাঙচুরের তথ্য রয়েছে। শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের স্থানীয় পুর-প্রধান মেহবুব আলম (যদিও তিনি এখন প্রাক্তন, তাঁর স্ত্রী পুর-প্রতিনিধি), এক বিধায়ক এবং আমিরুল ইসলাম নামে এক নেতার ভূমিকার কথাও রিপোর্টে স্থান পেয়েছে।

বাবা-ছেলে খুন হয়েছিলেন শমসেরগঞ্জ থানার জাফরাবাদে। একই থানা এলাকার তারবাগান, কামাত, নতুনবাজার, হাতিচিত্রা, লক্ষ্মীনগরে অন্তত ১২ জন গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনার কোনও উল্লেখ অবশ্য তথ্যানুসন্ধান কমিটির রিপোর্টে নেই। ধুলিয়ান পুরসভার বেতবোনা এবং আরও কয়েকটি পাড়ায় যে হামলা, ভাঙচুরের কথা সামনে এসেছে, একই পুরসভার অন্য কয়েকটি ওয়ার্ডের বাসিন্দারা অভিযোগ করেছিলেন বিএসএফের পোশাকে এক দল লোক পাড়ায় এসে গুলি চালিয়েছিল। গুলিবিদ্ধদের অধিকাংশই এলাকায় আছেন, আরও কয়েক জন বহরমপুর বা কলকাতায় চিকিৎসাধীন। হাতিচিত্রার রমজ়ান মহালদার বা কলকাতায় এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি হওয়া সমসের নাদাবের পরিবারের লোকজন জানাচ্ছেন, তাঁদের অভিযোগের কথা শুনতে কেউ যাননি। প্রশাসনও এখনও পর্যন্ত কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি, সুতির কাশিমনগরে পুলিশের গুলিতে নিহত যুবক ইজাজ আহমেদের কথাও রিপোর্টে নেই। বিজেপি নেতাদের দাবি, ইজাজ-সহ বাকিরা সংঘর্ষে লিপ্ত ছিলেন, তাই গুলি খেয়েছেন। কিন্তু রিপোর্টে অন্তত এই বিষয়ে কোনও তথ্য নেই।

রিপোর্টে স্বভাবতই খুশি বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমরা যা বলছি, হাই কোর্ট নিযুক্ত কমিটি সে কথাই বলেছে। পরিষ্কার কথা, তৃণমূলের পুর-প্রতিনিধি, তৃণমূলের বিধায়ক গোলমাল লাগিয়ে এলাকা ছেড়েছেন। হিন্দু-নিধনে তৃণমূল কংগ্রেস স্পনসর করছে!’’ ঘটনার পরে রাজনৈতিক দলের মধ্যে প্রথম এলাকায় গিয়েছিলেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। তিনি কিন্তু বলছেন, ‘‘রহস্যময় অনেক ঘটনা আছে। যতটা প্রকাশিত হয়েছে, তার বেশি গোপন আছে। বিজেপি এবং তৃণমূল মিলে উস্কানি দিয়েছে, ঘটনা ঘটিয়েছে। পুলিশ-প্রশাসন যা বলছে, সবটা ঠিক নয়। আমরা বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি করেছি। বিচারবিভাগীয় তদন্তের প্রয়োজন আরও বাড়ে আদালতের নিজেদের কমিটির এই রিপোর্টের পরে। দোষীদের কড়া শাস্তি হওয়া দরকার।’’ সেলিমের মতোই আদালতের কমিটির রিপোর্টকে ‘আংশিক সত্য’ বলছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকার। তিনিও কংগ্রেসের প্রতিনিধিদল নিয়ে সংশ্লিষ্ট সব এলাকায় গিয়েছিলেন। শুভঙ্করের দাবি, ‘‘মেরুকরণের পরীক্ষাগার হিসেবে শমসেরগঞ্জে আগুন লাগানো হয়েছে। বিজেপি পেট্রল আনলে দেশলাই কাঠি দিয়েছে তৃণমূল। সব সত্য উন্মোচিত হওয়ার দরকার। হাই কোর্টের কর্মরত বিচারপতির নেতৃত্বে তদন্ত চাই।’’

ধুলিয়ানে তৃণমূলের প্রাক্তন পুর-প্রধান মেহবুব তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করেই দাবি করেছেন, পুলিশ সে দিন ফোন পেয়েও আসেনি। শমসেরগঞ্জের বাসিন্দা এবং ফরাক্কার তৃণমনূল বিধায়ক মনিরুল ইসলামের দাবি, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী কড়া পদক্ষেপ নিয়েছেন। শমসেরগঞ্জের তৎকালীন ওসি এবং এক এসআই-কে কে নিলম্বিত ( সাসপেন্ড) করা হয়েছে। এসপিকে বদলি করা হয়েছে। কোথাও যদি ফাঁক-ফোকর কিছু হয়ে থাকে তার সাজা ওঁরা পেয়েছেন।’’ তাঁর আরও মন্তব্য, ‘‘এই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে সকলকে।”

শুভেন্দু যেমন অশান্তি পাকানোর জন্য মনিরুল, তাঁর দাদা এবং ধুলিয়ানের বর্তমান পুর-প্রধানের দিকে আঙুল তুলেছেন, বিধায়ক আবার পাল্টা বিরোধী দলনেতাকে দুষছেন। আর বাম ও কংগ্রেস নেতাদের বক্তব্য, যা হয়েছে, তাকে ‘ভুল’ বলে না! অপরাধ বলে!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Murshidabad Unrest Calcutta High Court BJP TMC

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy