Advertisement
E-Paper

পুড়ল ডায়েরি, মোবাইল ডুবল আদিগঙ্গায়! সাত পথে নিয়োগ দুর্নীতির প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা বলে দাবি সিবিআই চার্জশিটে

চার্জশিটে সিবিআই জানিয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষক-সহ একাধিক সরকারি চাকরির নামে প্রার্থীদের কাছ থেকে টাকা তোলা হয়েছে। কোটি কোটি টাকা গিয়েছে সুজয়কৃষ্ণ ভদ্রের হাতে। সাতটি উপায়ে সেই প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা করা হয়েছে।

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৭ মার্চ ২০২৫ ০৯:০১
How documents supporting recruitment case were distorted, reveals CBI charge sheet

নিয়োগ দুর্নীতির প্রমাণ লোপাটের জন্য একাধিক পন্থা অবলম্বন করা হয়েছিল, চার্জশিটে উল্লেখ করেছে সিবিআই। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় একাধিক ভাবে প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা করা হয়েছে বলে আদালতে জমা-দেওয়া চার্জশিটে দাবি করেছে সিবিআই। কখনও মামলার অন্যতম অভিযুক্ত ‘কালীঘাটের কাকু’ ওরফে সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র নিজে সে চেষ্টা করেছেন, কখনও আবার অন্যদের তিনি প্রমাণ লোপাটে বাধ্য করেছেন। ওই মামলার অন্য অভিযুক্তেরাও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে তথ্যপ্রমাণ নষ্ট করার চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ। নিয়োগ দুর্নীতি মামলার তৃতীয় অতিরিক্ত চার্জশিটে প্রমাণ লোপাটের মোট সাতটি উপায়ের কথা উল্লেখ করেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। তারা জানিয়েছে, বিভিন্ন সাক্ষীর বয়ান থেকেই ওই সাতটি উপায়ের কথা জানা গিয়েছে।

চার্জশিটে সিবিআই জানিয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষক থেকে শুরু করে এসএসসি বা বিভিন্ন সরকারি চাকরির নামে প্রার্থীদের কাছ থেকে টাকা তোলা হয়েছে। কোটি কোটি টাকা গিয়েছে সুজয়কৃষ্ণের হাতে। তার বিনিময়ে কেউ কেউ চাকরি পেয়েছেন। আবার অনেকে পাননি। কিন্তু তাঁদের টাকা ফেরত দেওয়া হয়নি। ওই টাকা তোলার কাজে একাধিক এজেন্টকে ব্যবহার করেছিলেন কুন্তল ঘোষ (হুগলি তৃণমূলের অধুনা বহিষ্কৃত নেতা), শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায় (হুগলি তৃণমূলের অপর বহিষ্কৃত নেতা), অরুণ হাজরার (আপাতত বিজেপিতে) মতো অভিযুক্তেরা। একে অপরের সঙ্গে তাঁদের কথোপকথন, ইমেল-সহ লেনদেন সংক্রান্ত প্রমাণ নানা ভাবে লোপাটের চেষ্টা করা হয়েছে। নিয়োগ মামলায় ইডি এবং সিবিআই সক্রিয় হয়ে ওঠার পরেই প্রমাণ নষ্টের জন্য চাপ দেওয়া হতে থাকে বলে সিবিআইকে জানিয়েছেন ওই এজেন্টরা। সিবিআইয়ের নথিতে প্রমাণ লোপাটের যে সাত পন্থার কথা উঠে এসেছে সেগুলি হল—

১. ডায়েরিতে আগুন

নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে নেমে সুজয়কৃষ্ণের এক ‘সহযোগীকে’ জিজ্ঞাসাবাদ করে সিবি‌আই। সেই সহযোগীর ২০২৪ সালের ২০ ডিসেম্বরের বয়ান অনুযায়ী, তিনি অরুণ এবং তাঁর এজেন্টদের কাছ থেকে টাকা তুলতেন। কার কাছ থেকে কবে কত টাকা পেলেন, তার হিসাব একটি ডায়েরিতে লিখে রাখতেন। এমন একাধিক ডায়েরি তাঁর কাছে ছিল। পরে সুজয়কৃষ্ণের নির্দেশে ওই ডায়েরিগুলি তিনি আগুনে পুড়িয়ে দেন। টাকা তোলার হিসাব যাতে কোনও তদন্তকারী সংস্থার হাতে না যায়, তা নিশ্চিত করতেই ওই নির্দেশ দিয়েছিলেন সুজয়কৃষ্ণ। ওই এক এজেন্ট তাঁর কাছে গচ্ছিত ডায়েরিগুলি পুড়িয়ে দিলেও নিয়োগ মামলার তদন্তে নেমে অরুণের চার জন এজেন্টের কাছ থেকে ওই ধরনের অন্য ১০টি ডায়েরি উদ্ধার করেছে সিবিআই। তাতেও প্রার্থীদের নাম-তারিখ উল্লেখ করে টাকা তোলার হিসাব লেখা রয়েছে। নিয়োগ মামলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসাবে ডায়েরিগুলিকে দেখছে সিবিআই।

২. ঘুষের ভিডিয়ো গায়েব

চাকরির জন্য ঘুষ নেওয়ার ভিডিয়ো রেকর্ড করা হয়েছিল বলে এক সাক্ষীর বয়ান থেকে জানতে পেরেছে সিবিআই। কিন্তু পরে সেই ভিডিয়ো মুছে ফেলতে বাধ্য করা হয়। ওই সাক্ষী ২০২৪ সালের ১৪ নভেম্বর দেওয়া তাঁর বয়ানে জানিয়েছেন, তিনি সুজয়কৃষ্ণের উপস্থিতিতে এক বার তাঁর এক সহযোগীকে ঘুষ দেওয়ার ভিডিয়ো রেকর্ড করেছিলেন। দীর্ঘ দিন সেই ভিডিয়ো তাঁর ফোনেই ছিল। পরে মামলা নিয়ে ইডি এবং সিবিআই সক্রিয় হলে সুজয়কৃষ্ণ ফোন করে তাঁকে ওই ভিডিয়ো মুছে ফেলতে অনুরোধ করেন। তাঁর কথায় ফোন থেকে ওই ভিডিয়োটি মুছে দিয়েছিলেন সাক্ষী। অন্যান্য নথিও মুছে ফেলা হয়েছিল।

৩. মোবাইলের আদিগঙ্গাপ্রাপ্তি

ওই সাক্ষীই ১১ নভেম্বরের (২০২৪) বয়ানে সিবিআইকে জানিয়েছেন, এক বার ঘুষের টাকা সুজয়কৃষ্ণের হাতে তুলে দেওয়ার সময়ে তিনি লুকিয়ে নিজের মোবাইলে সেই ভিডিয়ো রেকর্ড করে রেখেছিলেন। পরে প্রার্থীরা চাকরি না পাওয়ায় সেই ভিডিয়ো দেখিয়ে সুজয়কৃষ্ণকে ‘ফাঁসানোর’ হুমকি দিয়েছিলেন ওই সাক্ষী। তাঁর অভিযোগ, তখন সুজয়কৃষ্ণ তাঁকে পাল্টা হুমকি দেন এবং তাঁর ফোনটি কেড়ে নিয়ে নর্দমার জলে ফেলে দেন। শুধু তা-ই নয়, সুজয়কৃষ্ণ নিজের দু’টি মোবাইলও ফেলে দিয়েছিলেন আদিগঙ্গায়। সাক্ষীর ১৪ তারিখের বয়ান অনুযায়ী, সুজয়কৃষ্ণ তাঁকে একাধিক বার হোয়াট্‌সঅ্যাপে ফোন করেন এবং টাকা দেওয়া বা নেওয়ার যাবতীয় তথ্য ফোন থেকে সরিয়ে দিতে অনুরোধ করেন। সেই সময়েই তিনি সাক্ষীকে জানিয়েছিলেন, তিনি নিজের দু’টি মোবাইল কালীঘাটে আদিগঙ্গার জলে ফেলে দিয়েছেন।

৪. হার্ড ডিস্কের নথি লোপাট

চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি নিয়োগ মামলার তদন্তে আরও এক সাক্ষীর বয়ান রেকর্ড করে সিবিআই। ওই মামলায় যে এজেন্টের বয়ান নেওয়া হয়েছে, তিনি সম্পর্কে এই সাক্ষীর মামা। ওই সাক্ষী সিবিআইকে জানিয়েছেন, মামার নির্দেশে তিনি ল্যাপটপে চাকরিপ্রার্থীদের নামের তালিকা তৈরি করে রাখতেন। অন্তত দু’হাজার চাকরিপ্রার্থীর নাম ছিল তাঁর কাছে। কিন্তু তাঁর দাবি, ওই ল্যাপটপের হার্ডডিস্কে সমস্যা (ক্র্যাশ) দেখা দিয়েছিল। তাই তিনি তা ‘ফর্ম্যাট’ করেছিলেন। তার পরে চেষ্টা করেও আর প্রার্থীদের নামের তালিকাটি উদ্ধার করা যায়নি।

৫. মোবাইলের নথি

লিপ্‌স অ্যান্ড বাউন্ডস সংস্থার অন্যতম শীর্ষপদে ছিলেন সুজয়কৃষ্ণ। ওই সংস্থার এক মহিলা কর্মীর বয়ান ২০২৪ সালের ৭ অক্টোবর রেকর্ড করে সিবিআই। তিনি জানিয়েছেন, একাধিক এজেন্টের ইমেল তাঁর কাছে আসত। সুজয়কৃষ্ণের নির্দেশেই সেই ইমেল প্রিন্ট করে সেই মুদ্রিত নথি সুজয়কৃষ্ণকে দিতেন তিনি। ওই ইমেল থেকেই মহিলা জানতে পেরেছিলেন, সুজয়কৃষ্ণ প্রাথমিক, উচ্চ প্রাথমিক, এসএসসি, গ্রুপ সি, গ্রপ ডি কর্মী নিয়োগের বেআইনি কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত। মহিলা আরও জানান, জনৈক চন্দন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে তাঁকে নিজের মোবাইল থেকে যাবতীয় ছবি এবং হোয়াট্‌সঅ্যাপ চ্যাট মুছে ফেলতে হয়েছিল। কুন্তল, অরুণ কিংবা অরবিন্দ রায়বর্মণেরা যে লিপ্‌স অ্যান্ড বাউন্ডসের দফতরে যাতায়াত করতেন, তা কাউকে বলতে নিষেধ করা হয়েছিল। তাঁর অভিযোগ, ওই সংক্রান্ত কোনও তথ্য ফাঁস করলে তাঁকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকিও দেওয়া হয়।

৬. ইমেল অ্যাকাউন্ট বন্ধ

সিবিআই জানতে পেরেছে, প্রার্থীদের নাম, টাকা দেওয়া-নেওয়ার নির্দেশ ইত্যাদি বেশির ভাগই ইমেলে পাঠানো হত। একাধিক সাক্ষী জিজ্ঞাসাবাদের মুখে ইমেল মুছে দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। সুজয়কৃষ্ণ নিজের ইমেল অ্যাকাউন্টও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সিবিআইয়ের চার্জশিট অনুযায়ী, এসইউজে...জিমেল.কম— এই ইমেল আইডি ব্যবহার করতেন সুজয়কৃষ্ণ। তিনি ইমেল অ্যাকাউন্টটিই মুছে দিয়েছিলেন। অন্যদেরও ইমেল মুছতে বাধ্য করেছিলেন। তবে যাঁদের তিনি প্রার্থীদের নাম ইমেলে পাঠিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকের কাছ থেকে এই সংক্রান্ত তথ্য উদ্ধার করতে পেরেছে সিবিআই। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এক সাক্ষী কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাকে জানান, সুজয়কৃষ্ণের সঙ্গে যাবতীয় ইমেলের বার্তালাপ মুছে ফেলার নির্দেশ তাঁকে দিয়েছিলেন কুন্তল। তাই তিনি ১৫.৮.২০১৯ তারিখের আগের সব ইমেল মুছে দেন। পরে ২০ ডিসেম্বরে এক সাক্ষী জানিয়েছেন, তিনি সুজয়কৃষ্ণকে প্রার্থীদের নাম ইমেল করতেন। এমন দু’টি ইমেল আইডি ছিল। একটি আইডি থেকে সব ইমেল তিনি মুছে দিয়েছেন। অন্য আইডির পাসওয়ার্ড ভুলে গিয়েছেন।

৭. সিসিটিভি বন্ধ

সেপ্টেম্বর মাসে আর এক সাক্ষী সিবিআইকে জানান, তাঁরা ঘুষের টাকা তুলে দিতে লিপ্‌স অ্যান্ড বাউন্ডসের দফতরে যেতেন। সেখানে এক মহিলা কর্মী আগে তাঁদের আগমনের খবর সুজয়কৃষ্ণকে জানাতেন। সুজয়কৃষ্ণ অনুমতি দিলে তবেই তাঁদের ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হত। ওই সময়ে সুজয়কৃষ্ণ তাঁর দফতরের সমস্ত সিসি ক্যামেরা বন্ধ করে দিতেন। ওই মহিলা কর্মীও সিবিআইকে সিসি ক্যামেরা বন্ধের কথা জানিয়েছেন। তাঁর বয়ান অনুযায়ী, যখন দফতরে কেউ সুজয়কৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন, তখন তিনি জনৈক চন্দন বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ একাধিক কর্মীকে সিসিটিভি বন্ধ করে দিতে বলতেন।

Primary Recruitment Case CBI Sujay Krishna Bhadra Bengal Recruitment Case
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy