অনলাইন প্রতারণার জগতে এখন ত্রাস ‘ডিজিটাল অ্যারেস্ট’। লোক ঠকাতে ওটিপি চাওয়ারও প্রয়োজন পড়ছে না। ফোনেই ‘গ্রেফতার’ করে নেওয়া হচ্ছে! খোয়া যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা। মূলত বয়স্ক এবং সম্ভ্রান্ত নাগরিকেরা এই প্রতারণার নিশানা। তবে ডিজিটাল মাধ্যমে অজ্ঞতাই প্রতারকদের মূল হাতিয়ার। বিশেষজ্ঞদের মতে, অনলাইন কেনাকাটা এবং লেনদেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এই ধরনের প্রতারণা বেড়েছে। অবিলম্বে রাশ টানা না-গেলে আগামী দিনে আরও কঠিন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
অনলাইন প্রতারণায় একসময় জামতাড়া গ্যাংয়ের রমরমা ছিল। তবে কলকাতা পুলিশের একটি সূত্রের বক্তব্য, ডিজিটাল গ্রেফতারির সঙ্গে জামতাড়া গ্যাংয়ের কোনও সম্পর্ক নেই। তাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়ার মতো দেশ থেকে এই ধরনের প্রতারণাচক্র নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতারকদের চিহ্নিত করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংশ্লিষ্ট দেশগুলিতে। সেখানে বসে তাঁরা এ দেশের নাগরিকদের ফোন করছেন এবং টাকা হাতানোর চেষ্টা করছেন। এক-একটি পরিকল্পনা সফল হলে আদায়ীকৃত অর্থ ক্রিপ্টো কারেন্সিতে পরিবর্তন করে নেওয়া হয় বলেই জানাচ্ছেন তদন্তকারীরা।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক নিয়ন্ত্রিত ভারতীয় সাইবার অপরাধ সহযোগিতা কেন্দ্র ডিজিটাল অ্যারেস্টে ব্যবহৃত ১৭০০টির বেশি স্কাইপ আইডি এবং ৫৯ হাজার হোয়াট্সঅ্যাপ অ্যাকাউন্ট এখনও পর্যন্ত বন্ধ করেছে। আন্তর্জাতিক ভুয়ো ফোনকল ‘ব্লক’ করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা চালু হয়েছে। ডিজিটাল অ্যারেস্টের সঙ্গে যুক্ত মোট ৬.৬৯ লক্ষের বেশি সিমকার্ডও ‘ব্লক’ করেছে কেন্দ্র।
২০২৪ সালে ডিজিটাল অ্যারেস্টের ২০টি অভিযোগ কলকাতা পুলিশে দায়ের হয়েছিল। ৩৯ জনকে গ্রেফতারও করা হয়েছিল। সেখানে ২০২৫ সালের নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচটি অভিযোগ দায়ের হয়েছে। তার মধ্যে দু’টি ঘটনায় অভিযুক্তেরা গ্রেফতারও হয়েছে। প্রতিটি অভিযোগেরই তদন্ত এখনও জারি আছে বলে কলকাতা পুলিশের এক পদস্থ আধিকারিক জানিয়েছেন। তবে ডিজিটাল অ্যারেস্টের ঘটনা তুলনায় কম হলেও একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি।
কী ভাবে এই ফাঁদ থেকে রেহাই পাবেন সাধারণ নাগরিকেরা?
ডিজিটাল অ্যারেস্ট কী
পুলিশ, সাইবার শাখা, সিবিআই বা অন্য কোনও তদন্তকারী সংস্থার আধিকারিক সেজে ফোন করে অনলাইনে গ্রেফতারির ভয় দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পদ্ধতিই ডিজিটাল অ্যারেস্ট। কখনও কখনও কুরিয়ার সার্ভিস, আরবিআই, এনআইএ, এমনকি, আন্তর্জাতিক সংস্থার পরিচয়ও দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে প্রতারকেরা আর্থিক তছরুপ, মাদক সংক্রান্ত মামলা, বেআইনি পার্সেল বা আধার কার্ডের অপব্যবহারের মতো অভিযোগ তুলে ভয় দেখায়। মনে রাখতে হবে, কোনও দিন কোনও পুলিশ আধিকারিক ডিজিটাল মাধ্যমে কাউকে গ্রেফতার করতে পারেন না। রাজ্য পুলিশের সাইবার শাখার অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক কল্যাণ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘অ্যারেস্ট কখনও ‘ডিজিটাল’ হয় না। হোয়াট্সঅ্যাপ, স্কাইপ বা ভিডিয়ো কলের সঙ্গে গ্রেফতারির কোনও সম্পর্ক নেই। পুলিশ বা যে কোনও সংস্থা কাউকে গ্রেফতার করতে চাইলে সশরীরে উপস্থিত হয়ে অভিযুক্তকে স্পর্শ করে কারণ উল্লেখ করে বলবেন, আপনাকে গ্রেফতার করা হল। এ ছাড়া আর কোনও গ্রেফতারিতে বিশ্বাস করার প্রয়োজন নেই।’’ অন্য এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘পুলিশের কেউ অপরাধীর সঙ্গে ফোনে কথা বলতে চান না। ফোন ধরে রাখতে বা রেকর্ড করতে বলেন না। ফলে যদি কেউ ফোন করে নিজেকে পুলিশ বা অন্য কোনও আধিকারিক হিসাবে পরিচিত করেন, তা হলে সেটি ১০০ শতাংশ ভুয়ো।’’
শুরু কোথায়
এ রাজ্যে বছর দুয়েক আগে ডিজিটাল অ্যারেস্টের কথা প্রথম শোনা গিয়েছিল। সম্প্রতি তা বেড়ে গিয়েছে। কল্যাণের কথায়, ‘‘দু’বছর আগে আমরা প্রথম ডিজিটাল অ্যারেস্টের কেস পাই। তখন থেকেই টুকটাক এই ধরনের ঘটনা ঘটছিল। কিন্তু সেগুলো শুধু আমরা এবং ভুক্তভোগীরা জানতে পারছিলাম। গত চার-পাঁচ মাসে এটা ছড়িয়ে পড়েছে।’’ এই ধরনের প্রতারণা প্রতারকদের কাছে লাভজনক বলেই তার এত বিস্তার বলে মনে করেন কল্যাণ।
কী কী ফাঁদ
- কুরিয়ার সংস্থা থেকে ফোন করে বলা হচ্ছে, ‘‘আপনার নামে একটি পার্সেল থেকে মাদক/নগদ টাকা/পাসপোর্ট উদ্ধার করা হয়েছে।’’ এর পর ফোনটি কোনও ‘পুলিশ অফিসার’ বা ‘সাইবার সেলের’ সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে। তারা ভিডিয়ো কলে ভুয়ো এফআইআর এবং কেস নম্বর দেখায়। ফোন ধরে রাখতে বাধ্য করে এবং টাকা চায়।
- ফোন করে বলা হয়, ‘‘আপনার আধার/প্যান নম্বর আর্থিক তছরুপে বা বেআইনি কোনও কাজে ব্যবহার করা হয়েছে।’’ ফোনেই তাৎক্ষণিক গ্রেফতারির হুমকি দেওয়া হয়। কাউকে না জানিয়ে ফাঁকা এলাকায় গিয়ে ভিডিয়ো কল করতে বলা হয়। টাকা না দিলে ‘বেআইনি অ্যাকাউন্ট’ ফ্রিজ় করে দেওয়া হবে বলেও হুমকি দেওয়া হয়ে থাকে।
- মুম্বই পুলিশ, দিল্লি পুলিশ, সিবিআই, এনআইএ বা ইডির আধিকারিক সেজেও ফোন করা হয়। স্ট্যাম্প বসানো ভুয়ো পরিচয়পত্র দেখিয়ে বিশ্বাস অর্জনের চেষ্টা করা হয়। থানার মতো পরিবেশ সৃষ্টির জন্য নেপথ্যে কৃত্রিম শব্দও চালানো হয়।
- ক্রেডিট কার্ড যাচাইয়ের জন্য ফোন করে বলা হয়, ‘‘আপনার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, ইউপিআই বা কার্ডের মাধ্যমে অনিয়মিত লেনদেন হচ্ছে।’’ এতে ফরেন এক্সচেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট আইন (ফেমা) লঙ্ঘিত হয়েছে বলেও দাবি করা হয়।
- +৬৫, +৯৭১ বা +৮৫২ দিয়ে শুরু, এমন বিদেশি নম্বর থেকে ফোন আসে। বলা হয়, আপনার পাসপোর্ট অপরাধমূলক কাজে ব্যবহার করা হয়েছে।
- আয়কর দফতর, জিএসটি বা শুল্ক আধিকারিক সেজে ফোন করা হয়। কর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে বলে তারা অভিযোগ করে এবং সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার হুমকি দেয়।
- সমাজমাধ্যমের অ্যাকাউন্ট (ফেসবুক এবং ইনস্টাগ্রাম) অপরাধমূলক কাজে ব্যবহার করা হয়েছে বলেও দাবি করা হতে পারে ফোনে।
নিশানায় কারা
- সাধারণত বয়স্ক নাগরিকেরা ডিজিটাল অ্যারেস্টের প্রধান নিশানা। কারণ, এঁরা ডিজিটাল মাধ্যমে খুব স্বচ্ছন্দ নন। সহজে অচেনা ব্যক্তিকেও বিশ্বাস করে ফেলেন।
- যাঁরা খুব ব্যস্ত, বেশি সময় দিতে পারেন না, ঝামেলা এড়ানোর জন্য তাঁরা দ্রুত হুমকির মুখে মাথা নত করে ফেলেন।
- যাঁরা ঘন ঘন অনলাইনে কেনাকাটা করেন, তাঁদের পার্সেলের সঙ্গে অপরাধমূলক কাজের যোগ রয়েছে বলে ভয় দেখানো সহজ।
- যাঁরা আর্থিক সমস্যায় ভুগছেন বা সদ্য ব্যাঙ্কে বড় অঙ্কের টাকা রেখেছেন, তাঁদের অনেকের মনে ভয় কাজ করে।
- সামাজিক ভাবে যাঁরা উচ্চ অবস্থানে রয়েছেন, তাঁদের মানহানির ভয় দেখিয়ে কাবু করা হয়।
- যাঁরা বাড়িতে একা থাকেন, তাঁদের ভিডিয়ো কলে ভুল বোঝানো সহজ। জানাজানি হওয়ার ঝুঁকিও থাকে না।
কল্যাণ বলেন, ‘‘আর্থিক ভাবে সচ্ছলেরাই যে কেবল ডিজিটাল অ্যারেস্টের শিকার হবেন, তার কোনও মানে নেই। যে কোনও ব্যক্তিকেই নিশানা করা হতে পারে। মাসে ৪০ হাজার টাকা বেতন পান যিনি, তাঁকে ঠকিয়েও ৩৫ হাজার টাকা আদায় করে নেওয়া হচ্ছে। এমন ঘটনাও আমরা পেয়েছি।’’
গলদ কোথায়
দোকান-বাজার বা শপিং মলে অনেক সময় ব্যক্তিগত ফোন নম্বর চাওয়া হয়। সেখান থেকে প্রতারকেরা ফোন নম্বর জোগাড় করতে পারেন। সেই নম্বরের সঙ্গে যুক্ত আধার, প্যান কার্ডের তথ্য বার করে নেওয়া কঠিন নয়। এ ছাড়া, অনলাইনেও অনেক জায়গা থেকে এই ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হয়। এক পুলিশ আধিকারিকের কথায়, ‘‘ডেটা প্রোটেকশন আইনে বলা আছে, কোনও সার্ভার আমার তথ্য নিলে তা সুরক্ষিত রাখার দায়িত্বও তার। কিন্তু সে ভাবে নজরদারি না-থাকায় তথ্য ফাঁস হয়ে যাচ্ছে।’’
আরও পড়ুন:
ফোনের ‘রেড ফ্ল্যাগ’
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, এই ধরনের প্রতারকদের সঙ্গে কখনও তর্ক করা উচিত নয়। আপনি যে নির্দোষ, তা যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করাও অনুচিত। কারণ, আপনার ভয়ই তাঁদের হাতিয়ার। তাঁরা যুক্তি বোঝেন না। ফোনে নিম্নোক্ত কথাগুলির যে কোনও একটি শুনলেই ফোন কেটে দিন।
- ‘‘আপনার আধার/প্যান কার্ডের নম্বর ব্যবহার করে বেআইনি কাজ করা হয়েছে।’’
- ‘‘আপনার নামে মাদক-সহ একটি পার্সেল বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।’’
- ‘‘আমাদের কাছে আপনার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা আছে।’’
- ‘‘ভিডিয়ো কলে কথা বলুন।’’
- ‘‘এই ফোনের কথা অন্য কাউকে বলবেন না।’’
কী করবেন, কী নয়
নিজেদের ভুয়ো পরিচয়কে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য ভুয়ো পরিচয়পত্র এবং ভুয়ো গ্রেফতারি পরোয়ানা দেখাতে পারেন প্রতারকেরা। সেই সময় প্রথমেই সংশ্লিষ্ট থানা বা সংস্থার অফিশিয়াল ফোন নম্বরটি চান। তার পর নিজে সেই সংস্থার ফোন নম্বর আলাদা করে খুঁজে বার করুন এবং ফোন করে দেখুন। যে নম্বর ওঁরা দিয়েছেন, তাতে ভুলেও ফোন করবেন না।
- নিজের আধার, প্যান, ব্যাঙ্কের তথ্য, বায়োমেট্রিক বা ওটিপি যেখানে সেখানে প্রকাশ করবেন না।
- কোনও তথ্য যাচাইয়ের জন্য নিজস্বী বা ভিডিয়ো পাঠাবেন না। ব্যাঙ্ক বা ইউপিআই অ্যাপে নিরাপত্তার জন্য মাল্টি-ফ্যাক্ট অথেন্টিকেশন ব্যবস্থা চালু করে রাখুন।
- ১৯৩০ সাইবার অপরাধ বিভাগের হেল্পলাইন নম্বর। এখানে ফোন করে যে কোনও তথ্য যাচাই করে নিতে পারেন।
- জাতীয় সাইবার অপরাধ বিভাগের পোর্টালেও (cybercrime.gov.in) তথ্য যাচাই করা যায়।
- পুলিশের ওয়েবসাইটে বিভিন্ন থানার নম্বর দেওয়া থাকে। সেখানে ফোন করে খোঁজ নিন, আপনার নামে কোনও অভিযোগ দায়ের হয়েছে কি না।
- ভয় দেখিয়ে প্রতারকেরা আপনাকে একা করে দেওয়ার চেষ্টা করবে। সেটা হতে দেবেন না। এই ধরনের ফোনের কথা বিশ্বস্ত কাউকে জানিয়ে রাখুন।
ডিজিটাল অ্যারেস্টের বিরুদ্ধে সচেতনতার ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনে জোর দিতে বলছেন কল্যাণ। তাঁর কথায়, ‘‘টিভি চ্যানেল বা বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে ডিজিটাল মাধ্যমে সামান্য কয়েক সেকেন্ডের কোনও বিজ্ঞাপনের ব্যবস্থাও যদি করা যায়, বহু মানুষ সচেতন হতে পারবেন। ডিজিটাল অ্যারেস্ট বলে যে কিছু হয় না, তা স্পষ্ট করে বলে দিতে হবে। এসএমএসের মাধ্যমেও প্রচার করা যেতে পারে।’’
উল্লেখ্য, সরকারি উদ্যোগে ডিজিটাল অ্যারেস্টের বিরুদ্ধে একাধিক মাধ্যমে প্রচার শুরু হয়েছে। বিভিন্ন সংবাদপত্র, আকাশবাণী, এমনকি, দিল্লি মেট্রোতেও এই সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে।
(পুলিশ এবং সাইবার অপরাধ বিশেষজ্ঞদের থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে লিখিত)