মাস তিনেকের মধ্যে তৃতীয় বার পশ্চিমবঙ্গ সফরে আসছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। শেষ দু’টি সফরের মতো এ বারও প্রথমে প্রশাসনিক সভা, তার পরে রাজনৈতিক। কিন্তু এ বার প্রশাসনিক কর্মসূচি থেকে একাধিক বড় প্রকল্পের উদ্বোধনের কথা থাকলেও প্রায় সব শিবিরেই কৌতূহল তুলনায় বেশি মোদীর রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘিরে। আগামী বছরেই বিধানসভা নির্বাচন। তাই শুক্রবার দমদম সেন্ট্রাল জেল ময়দানের রাজনৈতিক সমাবেশের মঞ্চ থেকে মোদী কী বলবেন, কতটা আক্রমণাত্মক হবেন বা কোন কোন আশ্বাসবাণী শোনাবেন, তা শোনার আগ্রহ বাড়ছে। বস্তুত, শুক্রবার মোদী কী বলতে পারেন, তা নিয়ে নেতৃস্থানীয়দের নানা অনুমানের কথাও পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির অন্দরে ঘুরছে। যদিও কেউই হলফ করে কিছু বলতে রাজি নন।
মোদীর ভাষণ নিয়ে যে অনুমান রয়েছে, তা এ রাজ্যের বিজেপির কর্মী-সমর্থকদের চাহিদারই প্রতিফলন। সেই সূত্রেই অনেকের ধারনা, মোদীর ভাষণে তিনটি বিষয় থাকার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে— দুর্নীতি, উন্নয়ন এবং বাঙালি অস্মিতা।
তিনি কী বলতে পারেন, সে বিষয়ে সফরের একদিন আগে প্রধানমন্ত্রী নিজে কিছুটা আভাস দিয়েছেন। সমাজমাধ্যমে ইংরেজি ও বাংলায় একাধিক পোস্টে মোদী লিখেছেন, ‘কলকাতার জনসভায় পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির কর্মীদের মধ্যে উপস্থিত হতে আমি উদ্গ্রীব। প্রতি দিন তৃণমূলের বিরুদ্ধে জনতার আক্রোশ বাড়ছে। বিজেপির উন্নয়ন নীতির কারণে পশ্চিমবঙ্গ এখন বিজেপির দিকে আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে।’ এই পোস্টেই স্পষ্ট যে, পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসকের বিরুদ্ধে ‘জনরোষ’ এবং বিজেপির ‘উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে’র কথা মোদীর ভাষণে থাকবে। তিনটি নতুন মেট্রোপথের উদ্বোধন কলকাতার জন্য কতটা ‘সুবিধাজনক’ হল, সে কথাও প্রধানমন্ত্রী বলতে পারেন বলে তাঁর আর একটি পোস্ট আভাস দিচ্ছে। সেখানে মোদী লিখেছেন, ‘যে শহরের উন্নয়নের জন্য আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, সেই কলকাতার মানুষের কাছে আসা আমার কাছে সবসময়েই আনন্দের। কলকাতায় আগামিকালের অনুষ্ঠানগুলি মূলত যোগাযোগ সম্পর্কিত। নোয়াপাড়া-জয় হিন্দ বিমানবন্দর, শিয়ালদহ-এসপ্ল্যানেড এবং বেলেঘাটা-হেমন্ত মুখোপাধ্যায় রুটে মেট্রো চলাচলের উদ্বোধন হবে। এর ফলে বিমানবন্দর এবং আইটি হাবের সঙ্গে যাতায়াত সহজতর হবে।’’
কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের সুবিধা পশ্চিমবঙ্গবাসীকে পেতে দেওয়া হচ্ছে না বলে প্রধানমন্ত্রী আগেও একাধিক বার জনসভার মঞ্চ থেকে তোপ দেগেছেন। শুক্রবারের সভায় সেই বিষয়টিও তিনি আবার টেনে আনতে পারেন বলে বিজেপির একাংশের ধারণা।
২৯ মে আলিপুরদুয়ার এবং ১৮ জুলাই দুর্গাপুরের দুই জনসভা থেকেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সুর চড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তথা তৃণমূলকে আক্রমণ করেছিলেন মোদী। ‘বেলাগাম দুর্নীতি’র অভিযোগকে যে পশ্চিমবঙ্গের ভোটে তৃণমূলের বিরুদ্ধে অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হবে, সে বিষয়ে বিজেপি নীতিগত সিদ্ধান্ত আগেই নিয়েছে। তাই বাংলায় মোদী বা অমিত শাহের যে কোনও রাজনৈতিক ভাষণেই দুর্নীতির প্রসঙ্গ আসে। দুর্গাপুরের সভায় দুর্নীতি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে মোদী শুধু সরকারি অর্থ লুটের অভিযোগ করে থামেননি। সর্বস্তরে দুর্নীতির ফলে বাংলার অর্থনীতি তলিয়ে যাচ্ছে, নতুন লগ্নি হাতছাড়া হচ্ছে, পুরনো লগ্নিকারীরা রাজ্য ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন এবং এ সবের ফলে রাজ্যে কর্মসংস্থান ক্রমশ কমছে বলে মন্তব্য করেছিলেন। দমদমের সভায় সে প্রসঙ্গে নতুন কিছু বলবেন, না কি পুরনো কথাগুলোই নতুন মোড়কে পেশ করবেন, তা নিয়ে কৌতূহল রয়েছে।
রাজ্যের বিজেপি নেতাদের অনুমান, দমদমের ভাষণে ‘বাঙালি অস্মিতা’ প্রসঙ্গও গুরুত্ব পাবে মোদীর ভাষণে। রাঢবঙ্গের জনসভায় তিনি ‘জয় মা কালী, জয় মা দুর্গা’ স্লোগান তুলেছিলেন। ৩৬ মিনিটের ভাষণের এক-তৃতীয়াংশ জুড়ে বলেছিলেন বিভিন্ন যুগের এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রের কৃতী বাঙালিদের কথা, বাঙালির সম্মান এবং বাংলার সংস্কৃতির প্রতি বিজেপির শ্রদ্ধার কথা। এ বারের সভা দমদমে। অর্থাৎ দক্ষিণবঙ্গের প্রায় ভরকেন্দ্রে। ‘বাঙালিয়ানা’ বা ‘বাঙালি অস্মিতা’ প্রসঙ্গ এই অঞ্চলের ভোটেই সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। তাই শুক্রবারের সভাতেও মোদীর ভাষণে ‘বাঙালি অস্মিতা’র বন্দনা শোনা যাবে বলে রাজ্য বিজেপির অনেকের অনুমান।
শুক্রবার বিহারে একগুচ্ছ প্রকল্পের উদ্বোধন ও শিলান্যাস সেরে প্রধানমন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গে আসবেন। বিকেল ৪টে নাগাদ কলকাতা বিমানবন্দরে তাঁর নামার কথা। সেখান থেকে প্রথমে যাবেন নবনির্মিত যশোহর রোড মেট্রো স্টেশনে। ইয়েলো লাইনের (নোয়াপাড়া-বারাসত) নোয়াপাড়া থেকে জয়হিন্দ বিমানবন্দর অংশে মেট্রো চলাচলের আনুষ্ঠানিক সূচনা করবেন তিনি। সেখান থেকেই ভিডিয়ো কনফারেন্সের মাধ্যমে অরেঞ্জ লাইনের (নিউ গড়িয়া-বিমানবন্দর) হেমন্ত মুখোপাধ্যায় স্টেশন (রুবি) থেকে বেলেঘাটা স্টেশন এবং গ্রিন লাইনের (সেক্টর ফাইভ-হাওড়া ময়দান) এসপ্ল্যানেড স্টেশন থেকে শিয়ালদহ স্টেশন অংশে মেট্রো চলাচলের আনুষ্ঠানিক সূচনা করবেন। তার পরে যশোহর রোড স্টেশন থেকে মেট্রো চড়ে তিনি জয়হিন্দ বিমানবন্দর স্টেশন পর্যন্ত যাবেন। আবার মেট্রোতেই যশোহর রোড ফিরবেন। তার পরে সড়কপথে যাবেন সভাস্থলে। কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক জানিয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী ৫২০০ কোটিরও বেশি টাকা মূল্যের বিভিন্ন প্রকল্পের শিলান্যাস ও উদ্বোধন করবেন। দমদমে জনসভা শুরুর আগে প্রশাসনিক সভার মঞ্চ থেকে প্রধানমন্ত্রী শিলান্যাস করবেন ছয় লেনের এলিভেটেড কোনা এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের। ৭.২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই এক্সপ্রেসওয়ে তৈরিতে ১২০০ কোটি টাকা ব্যয় হবে।