কোনও ট্রেন দু’ঘণ্টা লেট, কোনওটা আবার পাঁচ ঘণ্টা! কিছু কিছু ট্রেন তো আবার সন্ধ্যার বদলে হাওড়ায় ঢুকছে মাঝরাতে। কখনও আবার ভোরও হয়ে যায়। বেশ কয়েক মাস ধরে দক্ষিণ-পূর্ব রেলের চিত্র এমনটাই।
দক্ষিণ-পূর্ব রেলের ট্রেনে যাতায়াত যাত্রীদের কাছে এখন বিভীষিকার পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। যাত্রীদের অভিযোগ, টাইম টেবিল না-মানা দক্ষিণ-পূর্ব রেলের দীর্ঘ দিনের সমস্যা। হাজার ‘দাওয়াই’তেও সেই সমস্যার সমাধান হয়নি! এক দিন ঠিক হয় তো, পরের দিনই সেই একই ছবি। হাওড়ার উপরে চাপ কমাতে প্রথমে শালিমার এবং পরে সাঁতরাগাছি স্টেশনের ‘উন্নয়নে’ মনোনিবেশ করেছিল দক্ষিণ-পূর্ব রেল। আর তা করতে গিয়ে যাত্রী ভোগান্তির গোদের উপর বিষফোড়া তৈরি হয়েছে। রেল কর্তৃপক্ষ জানেনও না কবে এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। আশু সুরাহা যে নেই তা স্পষ্ট হয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক ওমপ্রকাশ চরণের কথায়। কবে পরিষেবা স্বাভাবিক হবে প্রশ্নের জবাবে তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘আপনি কি জানেন কাল সুনামি আসবে কি না! এ ভাবে কখন কী হবে বলাটা খুবই মুশকিলের। আমরা চেষ্টা করছি। খুব দ্রুত সমস্যার সমাধান হবে।’’
হাওড়া স্টেশনের উপর থেকে চাপ কমানোর জন্যই সাঁতরাগাছি রেল ইয়ার্ডকে ঢেলে সাজার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। হাওড়ার বিকল্প হিসাবে সাঁতরাগাছিকে গড়ে তুলতে অনেক দিন ধরেই কাজ হচ্ছে সেখানে। সাঁতরাগাছি স্টেশনের প্রায় এক লক্ষ বর্গমিটার পরিসরযুক্ত পাঁচতলা ভবন, পার্কিং লট এবং কোনা এক্সপ্রেসওয়েকে যুক্ত করে র্যাম্প তৈরি হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, বসেছে নতুন লাইন, সিগনালিং ব্যবস্থাকেও উন্নত করার কর্মযজ্ঞ শুরু হয়। রেল ঘোষণা করে গত ১৮ মে সেই সব কাজ সম্পন্ন হয়েছে। খাতায়কলমে রবিবার কাজ শেষ হলেও সমস্যা মিটল কই! যাত্রীদের অভিজ্ঞতা, সমস্যা বরং বেড়েছে!
রেলের একটা অংশের দাবি, ১৮ মে কাজ শেষ হওয়ার পরেও নন-ইন্টারলকিং সিগন্যাল ব্যবস্থায় ত্রুটি থেকে গিয়েছে। নন-ইন্টারলকিং সিগন্যাল ব্যবস্থা সঠিক ভাবে কাজ না-করায় সোমবার থেকেই দক্ষিণ-পূর্ব রেলের হাওড়া ডিভিশনের ট্রেন চলাচল ব্যাহত হয়। মঙ্গলবার সেই সমস্যা আরও তীব্রতর আকার নেয়। কবে সমস্যা মিটবে, সদুত্তর নেই দক্ষিণ-পূর্ব রেলের কাছেও। বাতিল করা হয়েছে বেশ কয়েকটি দূরপাল্লার ট্রেনও। অসংখ্য লোকাল-মেল-এক্সপ্রেস বাতিল। যেগুলো চলছে তা-ও অনির্দিষ্ট সময়ে চলছে। দেরির কোনও সীমাপরিসীমা নেই।
কেউ কেউ সোমবার রাত থেকে বসে রয়েছেন হাওড়া স্টেশনে। কেউ আবার তারও আগে থেকে। কখন তাঁদের গন্তব্যে যাওয়ার ট্রেন ছাড়বে তার কোনও খবর নেই। রেলকর্মী বা অনুসন্ধান কাউন্টারে জিজ্ঞেস করলেও মিলছে না কোনও তথ্য। গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠার জোগাড় যাত্রীদের। সোমবারের পর মঙ্গলবারও এমন ছবি হাওড়া স্টেশনে নিউ কমপ্লেক্সে! রেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, সাঁতরাগাছি রেল ইয়ার্ডে নন-ইন্টারলকিং সিগন্যালে কাজ চলার কারণেই ভোগান্তি।
আরও পড়ুন:
লোকাল ট্রেনের পাশাপাশি দূরপাল্লার ট্রেনও দেরিতে চলছে। হাওড়া-মুম্বই গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেস, হাওড়া-মুম্বই দুরন্ত এক্সপ্রেস, হাওড়া-বেঙ্গালুরু দুরন্ত এক্সপ্রেস, হাওড়া-বেঙ্গালুরু হামসফর এক্সপ্রেস, হাওড়া-পুরী বন্দে ভারত এক্সপ্রেস, হাওড়া-সেকেন্দরাবাদ ফলকনুমা এক্সপ্রেস-সহ বেশ কিছু দূরপাল্লার ট্রেন মঙ্গলবার নির্ধারিত সময়ের অনেক দেরিতে ছাড়ে। বেশ কয়েকটি দূরপাল্লার ট্রেন সোমবারের বদলে মঙ্গলবার দুপুরে ছাড়ার কথা জানানো হয়। ফলে অনেক যাত্রীই সমস্যায় পড়েন। সোমবার সন্ধ্যা থেকে স্টেশনেই অপেক্ষা করতে দেখা যায় অনেককে।
দক্ষিণ ভারতে এ রাজ্যের একটা বড় অংশের রোগী যান চিকিৎসা করাতে। তাঁদের মধ্যে ক্যানসার আক্রান্তরাও আছেন। সময়মতো ট্রেন না চলায় স্টেশনেই রাত কাটছে সকলের। যাত্রীদের অভিযোগ, রেল কর্তৃপক্ষ সময় বদল করলেও কখন ট্রেন ছাড়বে বা কী কারণে দেরি সে সম্পর্কে সঠিক কোনও তথ্য দেননি। এমনকি, স্টেশনের ইলেকট্রনিক বোর্ডেও সঠিক তথ্য দেওয়া হচ্ছে না। তথ্য দেওয়া হলেও তা অনেক দেরি করে দিচ্ছেন রেল কর্তৃপক্ষ।
হাওড়া-দিঘা কান্ডারি এক্সপ্রেস, হাওড়া-বরবিল জনশতাব্দী এক্সপ্রেস, হাওড়া-পুরুলিয়া এক্সপ্রেসের মতো বেশ কিছু ট্রেন বাতিল করা হয়েছে মঙ্গলবার । এই সব ট্রেন ধরার জন্য অনেকেই হাওড়া স্টেশনে চলে এসেছিলেন। স্টেশনে এসে ট্রেন বাতিলের কথা জানতে পারছেন সকলে। ফলে সমস্যা বাড়ছে যাত্রীদের। এই প্রসঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক ওমপ্রকাশ বলেন, ‘‘সাঁতরাগাছি রেল ইয়ার্ডে নন-ইন্টারলকিং সিগনাল সিস্টেমের কাজের ফলে এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। দ্রুত সমস্যার সমাধান চেষ্টা চলছে। একটা সিস্টেম খারাপ হয়েছিল। সেটা শনাক্ত করা গিয়েছে। সোমবারের তুলনায় মঙ্গলবার পরিস্থিতি কিছুটা ভাল। আশা করা যায়, বুধবার থেকে পরিস্থিতি আরও উন্নত হবে।’’ তবে যাত্রীদের একাংশের দাবি, রেলের এই আশ্বাস শুধুই মুখের কথা। কাজে এর কোনও প্রতিফলন হবে না! গত কয়েক মাসের অভিজ্ঞতা তাই-ই বলে।