‘বিপ ফেস্টিভ্যাল’। ছবি সংগৃহীত।
কয়েক দিন আগের ছবিটা এখনও ঝকঝক করছে অনেকের স্মৃতিতেই।
মধ্য কলকাতার তস্য গলিতে পাশাপাশি দু’টি লাইন। খুপরি দোকানে আর উল্টো দিকের রোয়াকে শিকে গাঁথা কাবাব ঝলসানো চলছে। এক দিকে বিফ-প্রেমীরা লাইন দিয়েছেন। পাশেই গোমাংসবিমুখ ভোজনরসিকেরা অপেক্ষা করছেন চিকেন বা মাটন কাবাবের আশায়। কোথাও কোনও অশান্তি নেই। পুলিশ ডাকাডাকি বা লাঠালাঠির প্রশ্ন উঠছে না। রমজানের সন্ধ্যায় উৎসবের মেজাজে আমুদে জনতা আপরুচি মাংসের আশায় ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে আছেন।
প্রায় একই সময়ে নেটরাজ্যের একটা ছবি কিন্তু পুরো অন্য রকম। সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ক্যালকাটা বিফ ফেস্টিভ্যাল’-এর দিনক্ষণ ঘোষণা হতেই রীতিমতো যুদ্ধের ঝাঁঝ। কয়েক হাজার লোক সেই ভোজ-আসরে নাম লেখাতে চান। ফলে জায়গা পাল্টে একটি বড় হোটেলে উৎসবটি সরিয়ে নিয়ে গিয়েছেন আয়োজকেরা। আবার একই সঙ্গে আরও এক দল ‘ভাবাবেগে আঘাত’-এর দোহাই তুলে মারমুখী। উৎসবের আয়োজকদের লক্ষ্য করে লাগাতার গালাগাল, নেট-ট্রোলিং ছাড়াও যোগাযোগের কয়েকটি ফোন নম্বর ধরে হুমকি আসতে শুরু করেছে।
ফলে পিছু না হটলেও উদ্যোক্তারা কৌশলী হয়েছেন। উৎসবের নাম পাল্টে ‘বিফ’ থেকে ‘বিপ ফেস্টিভ্যাল’ হয়েছে। কারও কারও মনে পড়ে যাচ্ছে, কয়েক বছর আগে অমর্ত্য সেনকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্রে দেশে গোরক্ষকদের দৌরাত্ম্য প্রসঙ্গে ‘বিফ শব্দটি মুছে দিতে বলে সেন্সর বোর্ড। তখনও কিছুটা রসিকতার ছলে নেট-পাড়ায় বিফকে ‘বিপ’ বলা চালু হয়ে যায়।
কলকাতার উৎসবটি যাঁরা করছেন, তাঁদের তরফে অর্জুন কর বলছিলেন, ‘‘অশান্তি এড়াতেই নাম পাল্টেছি। মজার ব্যাপার, বিফকে বিপ করতেই ফোনে হুমকি-টুমকি প্রায় বন্ধ!’’ গোমাংসের নাম শুনেই নেট সৈনিক বা ফেসবুক সেনাদের ‘হুঙ্কার’-এর অভিজ্ঞতা অবশ্য নতুন নয়। কলকাতায় খাদ্যরসিকদের বিভিন্ন গ্রুপেই এমন ট্রোলিংয়ের ঘটনা ঘটেছে। লক্ষাধিক সদস্যের বিশালবপু ফেসবুক গ্রুপ ‘দ্য ক্যালকাটা ফুডিস ক্লাব’-এর বিভিন্ন পোস্টেও এমন কাণ্ড বারবার ঘটেছে। তবে ওই গ্রুপের ‘মাথা’রা একমত, বিফের পদের ছবিতে আপত্তির প্রশ্ন নেই। ‘‘কেউ অপছন্দের মাংসের ছবি দেখলেই উত্তেজিত হয়ে বিরোধিতা শুরু করে দেন। আবার কেউ কেউ ইচ্ছে করে উস্কানির তাগিদেই বিফের ছবি দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন।’’ — বলছেন অন্যতম অ্যাডমিন চন্দন গুপ্ত। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘দুটোই গোলমেলে প্রবণতা। এই ধরনের বাড়াবাড়ির দরুণ সেই প্রোফাইলধারীদের গ্রুপ থেকে সরিয়েও দিতে হয়েছে।’’
খাদ্যাখাদ্য বিচার নিয়ে দীর্ঘদিনই এ দেশে বিভিন্ন গোষ্ঠী রয়েছে। কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় খাদ্যাভ্যাসের কারণে ‘হিন্দু হোটেল’ বা ‘মুসলিম হোটেল’-এর বিভাজনও পুরনো। তা বলে হিন্দু হোটেলে অ-হিন্দু বা মুসলিম হোটেলে অ-মুসলিমদের প্রবেশাধিকার কখনও বন্ধ হয়নি। বেশির ভাগ হিন্দু বাড়িতে গোমাংস খাওয়ার চল নেই। ফলে, কারও কারও মধ্যে গোমাংস ঘিরে এক ধরনের নিষিদ্ধ রোমাঞ্চ আছে। আবার ধর্মীয় পরিচয় নির্বিশেষে গরু বা শুয়োরের নানা কিসিমের স্বাদ উপভোগ করতে আগ্রহী ভোজন-রসিকদের একটা দলও কলকাতার পরম্পরার সঙ্গে জড়িয়ে। এ কথা মনে করালেন শহরের ভোজনরসিকদের মধ্যে জনপ্রিয় ‘দ্য ক্যালকাটা পর্ক অ্যাডিক্ট’ গ্রুপের কাপ্তেন অয়ন ঘোষ।
শহরে শূকরমাংস বা পর্কের ‘অজানা’ সব পদ আবিষ্কারে ব্যস্ত গ্রুপটিতে কিন্তু আলোচনায় অহেতুক বিতর্ক বা রাজনীতির ছোঁয়াচ বরদাস্ত করা হয় না। কারা সত্যি স্বাদের প্রতি আগ্রহী, তা জরিপ করতে গ্রুপে অন্তর্ভুক্তির কিছু বাছাই-পদ্ধতি রয়েছে। অয়ন বলছেন, ‘‘গ্রুপে পর্ক নিয়ে চর্চা হলেও আমরা সবার ইচ্ছে মতো খাবারের অধিকারে বিশ্বাসী। উটকো ভিড় না বাড়িয়ে প্রধানত সমমনস্কদের নিয়েই ভাল আছি।’’ গোমাংসপ্রেমীদের একটি সর্বভারতীয় দল ‘বোভাইন ডিভিনিটি’-তেও পরিবেশ শান্তিপূর্ণ। কলকাতার অনেকেই রয়েছেন সেখানেও। অন্যতম অ্যাডমিন উৎসব গুহঠাকুরতা বলছেন, ‘‘কলকাতা বা বাংলার বাইরে কয়েকটি জায়গা গোমাংস-রসিকদের জন্য সব সময়ে নিরাপদ নয়, এটা আমাদের মাথায় রাখতে হয়। তাই কারা গ্রুপে ঢুকছেন, তা কয়েকটি প্রশ্নে যাচাই করে নিই।’’
তবে সোশ্যাল মিডিয়ার ধর্ম বলছে, শুধু খাবার নয়, যে কোনও বিষয়েই তা ‘অপর’কে ট্রোল বা কোণঠাসা করারও মঞ্চ। কলকাতায় বিফ উৎসবের আয়োজকদের ভোগান্তি তাই খুব একটা অস্বাভাবিকও বলা যাচ্ছে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy