Advertisement
E-Paper

Covid19: কষ্ট হয় যখন দেখি, নিয়ম ভেঙে আমরাই করোনাকে ফিরিয়ে আনছি

আমাদের তিন জনের সংসারে সব থেকে প্রাণবন্ত মানুষটাকে করোনা ছিনিয়ে নিয়েছে ২০২০ সালের ১০ অগস্ট।

ব্রততী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০২২ ০৬:৫৫
রবিবার মুচিবাজারের মাছ কেনাবেচায় দূরত্ব-বিধির তোয়াক্কা না করেই উপচে পড়ল ভিড়।

রবিবার মুচিবাজারের মাছ কেনাবেচায় দূরত্ব-বিধির তোয়াক্কা না করেই উপচে পড়ল ভিড়। ছবি: সুমন বল্লভ।

পৌষ মাসের প্রথম দিন পুজো দিতে জোড়া মুলো নিয়ে ভোর সাড়ে ৪টেয় শ্যামনগরের কালীবাড়ি পৌঁছে যেতাম আমি আর ডাক্তারবাবু। এটাই ছিল প্রতি বছরের রেওয়াজ। গত পৌষ থেকে সেই প্রথায় ছেদ পড়েছে। ঠিক করেছি, আর পুজো দেব না। উৎসব আমাদের যন্ত্রণা বাড়িয়ে দেয়। তবে অন্যদের উৎসব পালন করতে দেখে দুঃখ হয় না। মনে করি, এই আবেগটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু কষ্ট হয় যখন দেখি, বার বার নিয়ম ভেঙে আমরাই করোনাকে ফিরিয়ে আনছি। এক বারও ভাবা হয় না, এই অতিমারি কত মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নিল, কত মানুষকে নিঃস্ব করে দিল, কত জনের মাথার ছাতা কেড়ে নিল।

আমাদের তিন জনের সংসারে সব থেকে প্রাণবন্ত মানুষটাকে করোনা ছিনিয়ে নিয়েছে ২০২০ সালের ১০ অগস্ট। সেই দুঃস্বপ্ন আজও তাড়া করে। আজীবন করবে, জানি। প্রথম তিন মাস শুধুই অঝোরে কেঁদেছিলাম। ওই মানুষটাকে
ছাড়া কী ভাবে দিনগুলো পেরোতে হয়, সেটাই বুঝতে পারতাম না। সকাল ৬টায় ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে সংসারের প্রতিটি জিনিসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকতেন ডাক্তারবাবু। এমনই ছিলেন শ্যামনগরের ফিডার রোডের বটতলার বাসিন্দা, চিকিৎসক প্রদীপ ভট্টাচার্য। আমার স্বামী। তবে অভিভাবক, বন্ধু হয়েই আমার সব সম্পর্কে জুড়ে ছিলেন তিনি। রোগী-পাগল মানুষটা নিজেই বাজার করতেন। কী রান্না হবে, কোথায় কী ভাবে টাকা জমা রাখা হবে, ভবিষ্যতে বৃদ্ধাশ্রম তৈরির স্বপ্ন— সবটুকু নিজেই বুনতেন। আমাকে সে সব বলতেন। ওঁর প্রতিটি কাজে থাকত আমার সমর্থন।

বাড়ির নীচেই ছিল ওঁর চেম্বার। সপ্তাহের একটি দিন, বৃহস্পতিবার চেম্বার বন্ধ থাকত। ওই দিন আমরা ছেলে চিরাগকে নিয়ে কলকাতায় বেড়াতে যেতাম। কিন্তু ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে বৃহস্পতিবারেও রোগীদের জন্য চেম্বার খুলে রাখতেন তিনি। ওই অসময়ে রোগীদের জন্য দরজা খুলে রেখে, পরিবার থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে চিকিৎসায় ডুবে থাকতেন। তখন করোনা নিয়ে চার দিকে ভয়, কুসংস্কার, একঘরে করে রাখার আতঙ্ক ছড়াচ্ছিল। কিন্তু ওঁকে সকলে এতই ভালবাসতেন যে, পাড়ায় কোনও বাধার মুখে পড়তে হয়নি। কারও ইনহেলার নেই, কোনও রোগী ওষুধ পাবেন না— তাঁদের জন্য কখনও নিজের থেকে, কখনও বা চেয়েচিন্তে ওষুধের জোগান দিয়ে গিয়েছেন।

তখন লকডাউন চলছে। রোগী দেখতে দেখতে হঠাৎ আমাকে বললেন, ‘শোনো, বয়স্ক মানুষটা কিছু খাননি। এ দিকে এখনই ওষুধ খাওয়া জরুরি। তুমি ঘর থেকে কিছু খাবার দাও তো।’ ডাক্তারবাবুর এমন ধারা অবশ্য সব সময়েই ছিল। কোন বৃদ্ধাকে তাঁর সন্তান দেখেন না, তাঁর চিকিৎসা করেই শুধু ক্ষান্ত হতেন না। আমার দুপুরের ঘুম ভাঙিয়ে তাঁর খাবারের ব্যবস্থা করিয়ে, তাঁকে ওষুধ খাইয়ে, রিকশা ডেকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে তবে স্বস্তি পেতেন।

বাড়িতে যাঁরা কাজ করতেন, তাঁদের কথাও ভুলতেন না। লকডাউন চলাকালীন এক দিন বললেন, ‘‘ঘরে তো চাল আছে। ওঁদের দিলে কিছু দিন চলে যাবে। আগে সেই কাজটা করি। ঘরের জন্য পরে কিনে আনছি।’’ আমি শুধু সেই নির্দেশ পালন করতাম। কখনও বিরোধিতার কথা ভাবিইনি।

তাই যখন মাত্র ছাপান্ন বছর বয়সে করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় গেলেন, বাধা দিইনি। শুধু জানতে চেয়েছিলাম, এত দূরে একা একা কোথায় যাচ্ছ? যাওয়ার সময়ে পিছন ফিরে বাড়ির দিকে বার কয়েক দেখে বলেছিলেন, ‘‘আসছি।’’ সেটাই বিশ্বাস করেছিলাম, যে উনি আসবেন। পরে বুঝেছি, মানুষটার উপরে এতটা নির্ভর না করলে, চলার পথ হয়তো কিছুটা সহজ হত।

এখন আমার একটাই লক্ষ্য, আমাদের ছেলেটাকে মানুষ করা। একাদশ শ্রেণিতে পড়ে চিরাগ। কোনও আশা করি না। আশাভঙ্গ হলে কষ্ট অনেক।

লেখক: কোভিডে মৃত চিকিৎসকের স্ত্রী

Coronavirus in Kolkata COVID19
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy