কর্মকাণ্ড: দুর্গা পিতুরি লেনের একটি বাড়িতে মেরামতির কাজ চলছে। রবিবার। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
বৌবাজারের দ্বিতীয় বার বিপর্যয় একটি বড় প্রশ্নকে সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তা হল, শহরের চুন-সুরকির বাড়ির ভবিষ্যৎ কী? কারণ, বৌবাজারের বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িগুলির সিংহভাগই পুরনো বা চুন-সুরকির তৈরি। চুন-সুরকির বাড়ি কাঠামোগত দিক থেকে এমনিতেই ভঙ্গুর। তা ছাড়া কেন্দ্রীয় আবাসন ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের অধীনস্থ ‘বিল্ডিং মেটেরিয়ালস অ্যান্ড টেকনোলজি প্রোমোশন কাউন্সিল’-এর (বিএমটিপিসি) সমীক্ষা অনুযায়ী, কলকাতা মাঝারি ভূকম্পপ্রবণ ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার অন্তর্গত। যা প্রবল ভূকম্পপ্রবণ ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনাকে ছুঁয়ে রয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই বৌবাজার-সহ কলকাতার চুন-সুরকির বাড়িগুলির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বিশেষজ্ঞদের একাংশের বক্তব্য, ক্ষতির মাত্রার ভিত্তিতে বৌবাজার-সহ শহরের বাড়িগুলির জন্য প্রাথমিক ভাবে তিনটি রং প্রয়োজন— সবুজ, হলুদ ও লাল। মানচিত্রে এই তিন রঙের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট বাড়িগুলি চিহ্নিত করা যাবে। সবুজ রঙে চিহ্নিত বাড়ির অর্থ, সেগুলির কাঠামো ভাল এবং বাসযোগ্য। হলুদ রঙের অর্থ, ওই সব বাড়ির কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তবে তা মেরামতযোগ্য। লাল রঙের অর্থ হল যে বাড়িগুলি কোনও ভাবেই মেরামত করা যাবে না এবং ভেঙে ফেলতে হবে। আন্তর্জাতিক স্তরে এই নিয়ম মেনেই ভূকম্প পরবর্তী বিপর্যয়ের মোকাবিলা করা হয়ে থাকে। আমেরিকায় যেমন ‘ফেডারেল ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি’ (ফেমা) রয়েছে। এ দেশেও ভূকম্প পরবর্তী কাঠামো সংরক্ষণের কাজের ক্ষেত্রে এই নীতিই অনুসরণ করা হয়।
বৌবাজারেও সেই একই নীতি অনুসরণ করা দরকার বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা। কারণ, এখানকার বাড়ির নীচে ভূগর্ভে জল ঢুকে তার স্থিতাবস্থা বিঘ্নিত হয়েছে। এক বিশেষজ্ঞের কথায়, ‘‘মাটির কম্পনে শহরের পুরনো বাড়ির কী অবস্থা হতে পারে, বৌবাজার তার একটি উদাহরণ। এখনও সতর্ক না হলে আরও বড় বিপর্যয় অপেক্ষা করছে।’’ কলকাতা পুরসভার হিসেব অনুযায়ী, বৌবাজারে পঞ্চাশটিরও বেশি চূড়ান্ত বিপজ্জনক বাড়ি রয়েছে। এক বিশেষজ্ঞের কথায়, ‘‘অনেক বাড়ি হয়তো আপাতদৃষ্টিতে ভঙ্গুর নয়। কিন্তু আর কিছু বছর পরে সেগুলিরও একই অবস্থা হবে। ফলে বিপর্যয়ের জন্য অপেক্ষা না করে এখন থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। সেই কারণে সবুজ, হলুদ ও লাল রঙে বাড়িগুলিকে চিহ্নিত করা প্রয়োজন।’’
এ ক্ষেত্রে সবার আগে বাড়িতে ফাটল কী ভাবে ধরেছে, তা পরীক্ষা করা দরকার বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা। কারণ, ফাটলের চরিত্রের উপরেই সংরক্ষণের নীতি নির্ভর করছে। বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, ভূমিকম্প পরবর্তী বিপর্যয় মোকাবিলায় প্রথমেই ক্ষতির মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। সেখানে কোন ফাটল কতটা বিপজ্জনক, কেন হল— সে সব বার করা হয়।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অতিথি অধ্যাপক বিশ্বজিৎ সোম জানাচ্ছেন, ফাটল কতটা বড়, শুধু তা দেখলেই হবে না। ফাটলটা পুরো গাঁথনি দিয়ে গিয়েছে না কি ইট ভেঙে বেরিয়েছে, তা-ও পরীক্ষা করা দরকার। অর্থাৎ, ফাটলের কারণ বার করা প্রয়োজন। তার ভিত্তিতেই ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ সম্ভব। বিশ্বজিৎবাবুর কথায়, ‘‘ক্ষতির পরিমাণ বেশি হলে বিল্ডিংকে লাল রঙে চিহ্নিত করা হয়, অর্থাৎ সেটা ভাঙতে হবে। আর মেরামতযোগ্য বাড়ি কোনও রকমে মেরামত করলেই হবে না। কাঠামোর স্থায়িত্বের জন্য ভিত থেকে মেরামত করতে হবে। সারা শহরে পুরনো বাড়ির ক্ষেত্রেই এই নীতি নেওয়া প্রয়োজন।’’
তবে বৌবাজার প্রসঙ্গে মেয়র ফিরহাদ হাকিমের বক্তব্য, ‘‘এলাকার মাটির কী অবস্থা, ভূগর্ভে নড়াচড়ায় কতটা স্থিতাবস্থা বিঘ্নিত হয়েছে, আগে তা দেখা হবে। এ ব্যাপারে কেএমআরসিএলের রিপোর্টের উপরে আমরা নির্ভর করছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy