E-Paper

খাস কলকাতাতেও বাড়িতে প্রসবের ভাবনা, শঙ্কিত চিকিৎসকেরা 

শেষ দু’মাসে ভরসা জুগিয়েছিলেন এলাকায় কাজ করতে আসা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দাদা-দিদিরা। বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন বীথির স্বামীকেও।

স্বাতী মল্লিক

শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০২৩ ০৭:৫১
An image of a mother with her new born child

দেশে গত কয়েক বছরে প্রসূতি-মৃত্যুর হার কমেছে। প্রতীকী ছবি।

‘‘স্বামী না চাইলেও আমি হাসপাতালেই যেতে চেয়েছিলাম। না-হলে আমার জানটা যদি চলে যেত!’’

সদ্যোজাত ছেলেকে কোলে নিয়ে ফোনে সোমবার যখন এ কথা বলছিলেন তরুণী বীথি খাতুন, তাঁর স্বামী তখন কাজে। ৩ এপ্রিল সকালে যখন প্রসববেদনা উঠেছিল বীথির, তখনই জানতেন, স্বামী দাইমাকে ঘরে ডেকে এনেই দায় সারবেন। কারণ, গত ন’মাস ধরে সে কথাই শুনে এসেছেন স্বামীর মুখে। শুধু তা-ই নয়, অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় হাসপাতাল, ডাক্তার, ওষুধ, পথ্য— স্ত্রীর জন্য কোনও কিছুরই বালাই রাখেননি বীথির স্বামী।

তবে শেষ দু’মাসে ভরসা জুগিয়েছিলেন এলাকায় কাজ করতে আসা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দাদা-দিদিরা। বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন বীথির স্বামীকেও। তাই সে দিন ব্যথা উঠতেই বীথি সোজা প্রতিবেশিনী স্বাস্থ্যকর্মীকে ডেকে অনুরোধ করেন তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে। স্বামীর মতামতকে কার্যত উপেক্ষা করেই! শেষে ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তৎপরতায় এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি হয়ে সুস্থ পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছেন বছর আঠারোর বীথি। ‘‘বর বলেছে, এ বার থেকে আমাকে আর ছেলেকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। চিকিৎসা করাবে।’’— আশাবাদী শোনায় অপুষ্টিতে ভোগা ওই তরুণীর গলা।

খিদিরপুরের পাহাড়পুর এলাকার বস্তির বাসিন্দা বীথি একা নন। খাস কলকাতায় থেকেও এমন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাওয়া তরুণী বা মহিলার সংখ্যা কম নয়। তাই আজ, মঙ্গলবার ‘নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস’-এ বীথির উদাহরণকে সামনে রেখেই জনমানসে সচেতনতা বাড়াতে চাইছে শহরের একাধিক বস্তিতে জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলি।

এমনই এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মীরা জানাচ্ছেন, শহরের কোনও কোনও এলাকায় আজও এ নিয়ে সচেতনতা ও জ্ঞানের অভাব রয়েছে। সেখানকার বাসিন্দাদের বেশির ভাগেরই দিন আনি দিন খাই দশা। তাই কাজ কামাই করে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী বা মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে এঁদের প্রবল অনীহা। সিজ়ারিয়ান অস্ত্রোপচারের ভয়ে বাড়ির কাছাকাছি হাসপাতালেও না-যাওয়ার প্রবণতা রয়েছে। আর হাসপাতাল দূরে হলে তো কথাই নেই। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় এবং প্রসবের পরেও যে মায়েদের চিকিৎসার প্রয়োজন, তা এঁদের অজানা। সরকারি হাসপাতালে কার্ড করানো না থাকলে ভর্তিও করানো যাবে না— এমন ভ্রান্ত ধারণাও রয়েছে। ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তরফে শান্তনু রায়চৌধুরীর কথায়, ‘‘কমিউনিটি হেলথ ওয়ার্কারের থেকেই বীথির কথা জানতে পারি। শেষ দু’মাসে আমরা ওকে ফলিক অ্যাসিডের কিছু ওষুধ দিলেও সেটা খায়নি। বাড়িতেই সন্তান প্রসবের চেষ্টা করা হলে বড় বিপদের আশঙ্কা ছিল।’’

কী রকম? স্ত্রী-রোগ চিকিৎসক অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায়ের মতে, অন্তঃসত্ত্বাদের আয়রন, ফলিক অ্যাসিড, ক্যালসিয়ামের বড়ি খাওয়ানো না-হলে তাঁরা অপুষ্টির শিকার হবেন। গর্ভস্থ শিশুও সুস্থ হবে না। তাই দু’জনকেই সুস্থ রাখতে নিয়মিত ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন। তিনি বলছেন, ‘‘আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করিয়ে গর্ভাবস্থায় কোনও সমস্যা নেই বলে জানা গেলে, একমাত্র সে ক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত দাইমার তত্ত্বাবধানে সন্তান প্রসব করানো যেতে পারে। কিন্তু, কোনও রকম ডাক্তারি পরীক্ষা ছাড়া বাড়িতে প্রসব করানোর ফল মারাত্মক হতে পারে। সে ক্ষেত্রে মায়ের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। সন্তানেরও ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।’’

পরিসংখ্যান বলছে, দেশে গত কয়েক বছরে প্রসূতি-মৃত্যুর হার কমেছে। ২০১৬-’১৮ সালে প্রতি লক্ষ শিশুর জন্মে প্রসূতি-মৃত্যুর হার ছিল ১১৩, যা ২০১৮-’২০ সালে কমে হয়েছে ৯৭। তবে পশ্চিমবঙ্গে এই হার তুলনায় এখনও বেশি (১১৫)। সন্তান প্রসবের পরে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, সংক্রমণ, রক্তচাপ হঠাৎ বেড়ে যাওয়া-সহ একাধিক কারণে প্রসূতি-মৃত্যু বেশি হয়।

খাস কলকাতাতেই সন্তান প্রসবে অগ্রাধিকার পাচ্ছেন দাইমারা, এ বিষয়ে পুরসভা কী ভাবছে? মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) অতীন ঘোষের প্রতিক্রিয়া, ‘‘পুর এলাকার প্রতিটি ওয়ার্ডেই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে, যেখানে অন্তঃসত্ত্বা মহিলারা আসেন। পুরসভার বহু স্বাস্থ্যকর্মী এ নিয়ে প্রচারও চালান। তবে চিকিৎসা পরিষেবা নিতে না-চাওয়ার মতো মানসিকতা আজও আছে অনেকের। বন্দর এলাকায় হয়তো স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সচেতনতার প্রচারে ফাঁক রয়ে গিয়েছে। ঠিক ভাবে জানতে পারলে পুরসভা সেখানে এ নিয়ে সচেতনতার প্রচার চালাবে।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Baby Delivery Pregnancy Mother Care Social Awareness

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy