Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

কেবলই ভাবছি, রাতে গাড়ি খারাপ হলে কী করব

হায়দরাবাদের কাছে ২৬ বছরের তরুণীকে গণধর্ষণ এবং নৃশংস ভাবে খুনের ঘটনা শোনার পর থেকেই বারবার মনে হচ্ছে, যারা এমন কাণ্ড ঘটাল, তারা কারা? সারা দিন তারা কোথায় থাকে? শুনেছি, মেয়েটির স্কুটারের চাকা ফাটিয়ে দিয়ে তাঁকে ফাঁদে ফেলা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে এ শহরেই আমার এক অভিজ্ঞতার কথা।

চান্দ্রেয়ী ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৩:১৯
Share: Save:

বেশি রাত তো ছেড়েই দিলাম। সন্ধ্যা নামার পর থেকেই কেমন যেন বদলে যায় শহর কলকাতা। এমন কিছু মানুষের সঙ্গে তখন দেখা হয়, যাদের হাবভাব এমন যে, বোঝা যায় না সারা দিন তারা কোথায় থাকে। গত ২০ বছর ধরে আমি নিজেই গাড়ি চালাই। অনেক কিছুই বদলাতে দেখেছি, কিন্তু সন্ধ্যার পরে শহরের এই রং বদলানোটা আজও বদলাল না!

হায়দরাবাদের কাছে ২৬ বছরের তরুণীকে গণধর্ষণ এবং নৃশংস ভাবে খুনের ঘটনা শোনার পর থেকেই বারবার মনে হচ্ছে, যারা এমন কাণ্ড ঘটাল, তারা কারা? সারা দিন তারা কোথায় থাকে? শুনেছি, মেয়েটির স্কুটারের চাকা ফাটিয়ে দিয়ে তাঁকে ফাঁদে ফেলা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে এ শহরেই আমার এক অভিজ্ঞতার কথা।

বেশ কয়েক বছর আগেকার ঘটনা। সে দিন অফিস থেকে বেরোতে একটু দেরিই হয়ে গিয়েছিল। তখন রাত পৌনে ১১টা। লাউডন স্ট্রিটে তৎকালীন পুলিশ কমিশনারের বাড়ির সামনে হঠাৎই বিগড়ে গেল আমার গাড়িটা। কিছুতেই স্টার্ট নিচ্ছিল না। কী করব ভাবতে ভাবতেই দেখি, বেশ কিছু লোক এসে গাড়িটা ঘিরে ধরেছে। সাহায্য করার উদ্দেশ্যে যে তারা আসেনি, তা বেশ বুঝতে পারছিলাম। কোথা থেকে, কেন, কী ব্যাপার— তাদের এমন হাজারো প্রশ্নে আর যা-ই থাকুক, সাহায্য অন্তত

ছিল না।

কয়েক মিনিট পরে আরও অবাক হলাম পুলিশের ভূমিকা দেখে। ঘটনাস্থল কলকাতার পুলিশ কমিশনারের বাসভবনের কাছেই। দেখলাম, কমিশনারের বাড়ি থেকে দু’জন পুলিশকর্মী বেরিয়ে এলেন। ভাবলাম, এ বার হয়তো সাহায্য মিলবে। কিন্তু কোথায় কী! ওই দুই পুলিশকর্মী এসে এমন ভাবে ‘দেখা’ শুরু করলেন, যেন আমি কোনও উগ্রপন্থী! নাশকতা ঘটাব বলে গাড়ি নিয়ে কমিশনারের বাড়ির সামনে চলে এসেছি!

কোনও মতে এর পরে হলুদ ট্যাক্সি ডেকে ওখানেই গাড়ি রেখে বাড়ি চলে যাই। পুরনো এক চেনা মিস্ত্রিকে ডেকে গাড়ির চাবি দিয়ে দিই। তিনিই পরে ঘটনাস্থল থেকে আমার গাড়িটি উদ্ধার করে সারিয়ে ফেরত দেন। রাস্তায় সমস্যায় পড়লে বালিগঞ্জের একটি সংস্থা তাদের রেকার সার্ভিসে গাড়ি উদ্ধার করে দেয় বলে শুনেছি। তবে সেই রাতে ওই সংস্থার নম্বর আমার কাছে ছিল না।

ওই রাতের অভিজ্ঞতা আজ মনে পড়ছে আরও একটা কারণে। সে রাতে রাস্তায় একটা গাড়ি খারাপ হয়েছে, এটা বিশেষ কোনও ব্যাপারই ছিল না। আদতে ব্যাপার ছিল, একজন ‘মহিলার গাড়ি’ খারাপ হয়েছে। শহরের রাস্তায় এমন অভিজ্ঞতা অবশ্য বছর কুড়ি আগে গাড়ি চালানো শুরু করার সময় থেকে প্রায়ই হয়েছে। কত বার শুনতে হয়েছে, ‘‘হাতা-খুন্তিটাই তো ভাল ছিল, আবার গাড়ি চালাতে ইচ্ছে হল কেন?’’ কখনও বা শুনেছি— ‘‘কোন স্কুল থেকে শিখেছ মা!’’ পুরুষ চালকেরা যেন ধরেই বসে থাকেন যে, এক জন মেয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন মানে তিনি ঠিক ‘ম্যানেজ’ করতে পারবেন না। এখন অবশ্য এমন মন্তব্য একটু কম শুনি। তবে তা আমার পক্ককেশ আর বয়সের জন্য, না কি সমাজ সাবালক হয়েছে, তা বলতে পারি না।

গুরুগ্রামের একটি শপিং মলে এক বার আমার এক আত্মীয়া গাড়ি রাখতে সামান্য দেরি করায় এক নিরাপত্তারক্ষী বলেছিলেন, ‘‘গাড়ি চালাতে পারেন না যখন, চালান কেন?’’ গাড়ি পার্কিংয়ে রেখে সেই আত্মীয়াও তাঁকে কড়া জবাব দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রায় সর্বত্রই ভাবখানা এমন যে, মেয়েদের গাড়ি চালাতে দিচ্ছি এই না কত! শুধু চার চাকাই নয়, মোটরবাইক বা স্কুটার চালান যে সমস্ত মেয়ে, তাঁদেরও প্রায়ই এ হেন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতেহয়।

হায়দরাবাদের ঘটনাটি শোনার পর থেকে কেবলই ভাবছি, রাতবিরেতে রাস্তায় কখনও গাড়ি খারাপ হলে কী করব। কোন নম্বরে ফোন করলে সুরাহা হবে। কোনও চেনা লোককেই হয়তো ফোন করব, যিনি কাছাকাছি থাকেন। গাড়ির সার্ভিসিং যেখানে করাই, সেখানে ফোন করলেও কে আসবেন তা তো আর জানি না। তার চেয়ে চেনা কোনও গাড়িচালক বা বন্ধু-আত্মীয়কেই ভরসা করতে চাইব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE