ঘরে ঘরে জ্বর, সর্দি, কাশির প্রকোপ ক্রমশ বাড়ছে। শিশু থেকে মাঝবয়সি, বয়স্ক সকলেই এই সমস্যায় কাবু। কারও আবার সঙ্গে শ্বাসকষ্ট। ভিড় বাড়ছে হাসপাতালে, ডাক্তারের চেম্বারেও। পরিবারের এক জন আক্রান্ত হলে, ছড়াচ্ছে অন্যদের মধ্যেও। এই সমস্যার নেপথ্যে কি আবার কোভিড? জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞেরা করোনা সংক্রমণকে পুরোপুরি উড়িয়ে না দিলেও, সব থেকে বেশি দায়ী করছেন আবহাওয়ার তারতম্যে ভাইরাস ও ব্যাক্টিরিয়ার বাড়বাড়ন্তকে।
মাস কয়েক আগেও দেশ তথা রাজ্যে করোনার সংক্রমণ ধীরে হলেও মাথা চাড়া দিতে শুরু করেছিল।সেই প্রকোপ কি এখন নেই? চিকিৎসকদের দাবি, পরীক্ষা না হলে বোঝা সম্ভব নয়, জ্বর-সর্দি-কাশির সংক্রমণ বাধানোর নেপথ্যে করোনাভাইরাস দায়ী কিনা। কিন্তু এখন রোগীদের বেশির ভাগই সেই পরীক্ষা করাতে রাজি হচ্ছেন না। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ থেকে সংক্রামক রোগের চিকিৎসক সকলেই বলছেন, ‘‘কোভিড পরীক্ষার পরামর্শ দেওয়া হলেও, রোগীরা এড়িয়ে যাচ্ছেন। তাই করোনার প্রকৃত চিত্রজানতে গেলে আরও পরীক্ষার প্রয়োজন। যত ক্ষণ না রোগী গুরুতর সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তিহচ্ছেন, তত ক্ষণ ওই পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না।’’
তবে কোভিড সংক্রমণ আগের থেকে কমেছে বলেই দাবি ওই চিকিৎসকদের। বরং তাঁরা জানাচ্ছেন, এখন বেশির ভাগই ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশেষত শিশু, বয়স্ক ও কোমর্বিডিটিতে আক্রান্তদের সে ক্ষেত্রে প্রথম থেকে যথাযথ চিকিৎসা না করলে সমস্যা গুরুতর হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। শহরের এক বেসরকারি হাসপাতালের ক্রিটিকাল কেয়ারের চিকিৎসক সৌতিক পাণ্ডা জানাচ্ছেন, প্রায় প্রতিদিনই এক-দু’জন করে ‘ইনফ্লুয়েঞ্জা-এ’ পজ়িটিভ রোগী মিলছে। তাঁর কথায়, ‘‘ইনফ্লুয়েঞ্জার নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল থেরাপি রয়েছে। কোমর্বিডিটিতে আক্রান্ত ও বয়স্কদের একদম প্রথম থেকে সেটি দেওয়া প্রয়োজন। না হলে ঝুঁকি বাড়তে পারে।’’
জ্বর-সর্দি-কাশির এত বাড়বাড়ন্তের নেপথ্যে আবহাওয়ার তারতম্যকেই মূল কারণ বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিষয়ক চিকিৎসক অনির্বাণ দলুই। তাঁর কথায়, ‘‘কখনও বৃষ্টি হচ্ছে, কখনও আবার গরম। আর্দ্রতা বেড়ে গিয়ে, তাপমাত্রা কমে যাওয়ার পরিবেশে ভাইরাস ও ব্যাক্টিরিয়ার বংশবৃদ্ধির আদর্শ সময়। সেটাই এখন বেশি মাত্রায় হাওয়ায় আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়ছে।’’ বিগত বছরগুলিতেও বর্ষায় ড্রপলেট অর্থাৎ হাঁচি, কাশি, কফের মাধ্যমে ছড়ানো সংক্রমণের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছিল বলেও জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। অনির্বাণ জানাচ্ছেন, এই সংক্রমণের ফলে যে কাশি হচ্ছে, তা সারতেও অনেক দিন সময় লাগছে। অনেকেরই,বিশেষত বয়স্কদের শ্বাসকষ্টের উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। তাঁর কথায়,‘‘ড্রপলেটের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে মাস্ক পরা, হাত ধোয়ার মতো নিয়মগুলি মেনে চলা প্রয়োজন। পাশাপাশি বয়স্কদের ফ্লুয়ের প্রতিষেধকও নেওয়া দরকার।’’
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, হাঁচি-কাশির মধ্যে দিয়ে যে হেতু এই সংক্রমণ ছড়াচ্ছে, তাই পরিবারের এক জন আক্রান্ত হলেই অন্যেরাও সহজেই পর পর সংক্রমিত হচ্ছেন। সামগ্রিক পরিস্থিতে একশো জন আক্রান্তের মধ্যে এখন অন্তত ৯৫ শতাংশ ইনফ্লুয়েঞ্জা-এ ভাইরাসের বিভিন্ন উপপ্রজাতি দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছেন বলেও পর্যবেক্ষণ চিকিৎসকদের। কিছু ক্ষেত্রে আবার টাইফয়েডে আক্রান্ত রোগী মিলছে বলেও জানাচ্ছেন ইন্টারনাল মেডিসিনের চিকিৎসক নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘টাইফয়েড, ভাইরাল সংক্রমণের পাশাপাশি সামান্য কিছু ক্ষেত্রে ভাইরাল হেপাটাইটিসও মিলছে। আর বয়স্ক, সিওপিডি, অনাক্রমতায় আক্রান্তদের ক্ষেত্রে ব্যাক্টিরিয়ার মারাত্মক সংক্রমণও মিলছে।’’ তবে কোনও ক্ষেত্রেই নিজের ইচ্ছেমতো অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া যাবে না বলেও সতর্ক করছেনচিকিৎসকেরা। বরং জ্বর-সর্দি-কাশির উপসর্গ দেখা দিলে গোড়াতেই চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ওষুধ শুরু করার প্রয়োজন বলেই জানাচ্ছেন।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)