আগামী এপ্রিলে কলকাতায় নতুন যে কর-ব্যবস্থা চালু হচ্ছে, তা পুরনো করের থেকে অনেকটাই বেশি হতে পারে বলে আশঙ্কা ছিলই। তাই সাধারণ মধ্যবিত্ত, যাঁরা নিজের বাড়িতে নিজেরাই থাকেন, তাঁদের কিছুটা রেহাই দিতে পুর-আইনে সংশোধনী এনে নতুন করের উপরে ছাড়ের ব্যবস্থা করেছে সরকার। গত বৃহস্পতিবার বিধানসভায় মন্ত্রী-মেয়র এক বাক্যে জানিয়েছেন, শহরের সাধারণ মধ্যবিত্ত করদাতাদের কথা ভেবেই সংশোধনী বিলে এমনটা করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, বাড়তি করের একটা নির্দিষ্ট শতাংশ পর্যন্ত (যা ক্যাপ ইন বলে বিলে পাশ করা হয়েছে) দিলেই হবে।
বাড়ি নিয়ে ব্যবসা করেন, এমন করদাতারাও এখন ওই সংশোধনীর ফাঁক গলে সুবিধা পেয়ে যাবেন বলে মনে করছেন পুরকর্তাদের একাংশ। তাঁদের কথায়, সেই ছাড় কারা কতটা পেতে পারেন, তা নির্দিষ্ট করে বলা নেই ওই সংশোধনীতে। সে ক্ষেত্রে সকলকেই তা দিতে হলে পুরসভার আয় কমবে বলে আশঙ্কা তাঁদের। কী ভাবে তা থেকে বেরোনো যায়, এখন তার পথ খোঁজার কাজ চলছে। যদিও মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘আলাদা করে বিলে কিছু বলা নেই। তাতে কেউ সুবিধা পেতেই পারে। কী আর করার আছে?’’
সাধারণ মধ্যবিত্তদের কথা তুলে এটাকে উচ্চবিত্তদের ‘তোয়াজ’ বলেই মনে করছেন বিরোধী কাউন্সিলরেরা। কংগ্রেস কাউন্সিলর প্রকাশ উপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘২০১৫ সালে বকেয়া সম্পত্তিকর আদায়ে পুর-আইনের ২১৭ ধারায় একটা সংশোধনী এনে ৫০ শতাংশ সুদ মকুব করার ক্ষমতা পেয়েছেন মেয়র। তখনও বলা হয়েছিল, গরিব মানুষের (হার্ডশিপ) কথা ভেবেই তা করা হয়েছে। কিন্তু দেখা গিয়েছে, বেশির ভাগ উচ্চবিত্ত (যাঁরা নিয়মিত কর দেন না) মেয়রের কাছে আবেদন করেই সুদের উপরে ৫০ শতাংশ ছাড় পেয়ে যাচ্ছেন।’’ এ বারও তাই হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশবাবুর।
সম্পত্তিকর আদায়ে পুরনো পদ্ধতি ছেড়ে এলাকা-ভিত্তিক কর আদায় এক প্রকার বাধ্য হয়েই করতে হয়েছে পুর-প্রশাসনকে। পুরসভা সূত্রের খবর, নতুন পদ্ধতিতে (এলাকা-ভিত্তিক কর) বেশির ভাগ বাসিন্দারই কর অনেকটাই বেড়ে যাবে ভেবেই গত পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে তা তৈরি হয়ে থাকলেও কার্যকর করতে পারেনি পুরবোর্ড।
২০১১ সালে এলাকা-ভিত্তিক কর ব্যবস্থা নিয়ে সরকারি গেজেট প্রকাশিত হয়। পুরকর্তারা জানান, নতুন ওই পদ্ধতিতে অনেকের ক্ষেত্রেই কর অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার ইঙ্গিত মেলে। তা নিয়েই দ্বিধায় পড়ে পুরবোর্ড। হইচই পড়ে যায় নাগরিক মহলে। পুরসভার এক মেয়র পারিষদ বলেন, ‘‘মানুষের উপরে করের বোঝা অসম্ভব বেড়ে যাবে এমন কোনও সিদ্ধান্ত নিতে নারাজ দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সে কারণেই এলাকা-ভিত্তিক কর আদায়ের সব রকম ব্যবস্থা রেডি থাকলেও তা চালু করা হয়নি।’’ এ বিষয়ে এক উদাহরণ টেনে ওই মেয়র পারিষদ জানান, এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্কের আর্থিক সাহায্য পানীয় জল সরবরাহে প্রকল্প হয়েছে শহরে। তাদেরও শর্ত ছিল জলের জন্য কর নিতে হবে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে তৃণমূল বোর্ড কলকাতা কেন, রাজ্যের কোনও পুরসভায় জলের জন্য কর নেয় না। সে সব বুঝেই গত কয়েক বছর ধরে এলাকা-ভিত্তিক কর প্রয়োগে শহরের বিশিষ্ট মানুষজন এবং নাগরিকদের সঙ্গে আলোচনায় বসে পুর-প্রশাসন। তার পরেই ক্যাপ-ইন শব্দ জুড়ে সমাধানের পথ বেরোয়। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, কেউ নিজের বাড়িতে নিজেরাই থাকেন, কেউ বাড়ি ভাড়া দেন, কেউ বা বাড়িতে ব্যবসা বাণিজ্য করেন বা তার জন্য ভাড়া দেন, সকলের ক্ষেত্রেও ক্যাপ-ইনে ছাড় একই কেন।
এতে বলা হয়েছে, এলাকা-ভিত্তিক কর অসম্ভব বাড়লেও পুরোটা দিতে হবে না। বাড়তি করের একটা নির্দিষ্ট শতাংশ পর্যন্ত দিতে বলা হবে।
সেটা কেমন? উদাহরণ দিয়ে এক আমলা জানান, ধরা যাক, পুরনো পদ্ধতিতে কারও কর ছিল বছরে ১০০ টাকা। এলাকা-ভিত্তিক করের হিসেবে তা ১০০ শতাংশ বেড়ে ২০০ টাকা হল। এখন ক্যাপ-ইন পদ্ধতিতে পুরসভা হয়তে ঠিক করল, বাড়তি করের উপরে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি নেওয়া হবে। তা হলে ওই করদাতাকে ১২০ টাকা দিতে হবে। ২০০ টাকার মধ্যে ৮০ টাকা ছাড়। পুরসভার আমলাদের কথায়, সমস্যা হবে কার উপর কর মূল্যায়ন করা হবে তা নিয়ে। সমস্যা হচ্ছে কেউ নিজের বাড়িতে থাকেন, তিনি যে ছাড় পাবেন তার সঙ্গে বাড়ি ভাড়া দিয়ে যাঁরা রোজগার করছেন বা বাড়িতে ব্যবসা চালাচ্ছেন তাদের জন্য একই ছাড় দেওয়া নিয়ে। সংশোধিত বিলে তা নিয়ে কোনও কিছু বলা নেই। ফলে সকলেই একই ছাড়ের সুযোগ পেয়ে যাবেন। ওই আমলারা মনে করেন, ব্যবসা, বাড়ি ভাড়ার দেওয়ার মতো ক্ষেত্রে ছাড়ের পৃথক তালিকা হলে সমস্যা থাকত না।
কর নির্ধারণে সুপারবিল্ট নয়। ফ্ল্যাট ও বাড়ির সুপারবিল্ট হিসেব ধরেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সম্পত্তিকর আদায় করত পুরসভা। এ বার তা বন্ধ করতে নির্দেশ দিলেন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। সোমবার তিনি জানান, যতটুকু এলাকা বসবাসের জন্য ব্যবহার হয় (বিল্টআপ এরিয়া), তার উপরেই সম্পত্তিকর দিতে হবে।
পুরসভা সূত্রের খবর, এত কাল সম্পত্তিকর নেওয়া হত সুপারবিল্টের হিসেবে। তার মধ্যে লন, বাগানের মতো ফাঁকা জায়গাও জুড়ে থাকত। তাতে করের পরিমাণ বাড়ত। এ বার কেবলমাত্র বাসস্থানের ব্যবহারযোগ্য অংশের উপরে কর দিতে হবে। ফাঁকা অংশের জন্য কর বসবাসযোগ্য এলাকার থেকে ৫০ শতাংশ কম হবে।
অনেকেই সুপারবিল্টের জন্য সম্পত্তিকর দিয়েছেন। তা তাঁদের ফিরিয়ে দেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে মেয়র বলেন, ‘‘করদাতাদের কাছে এই নিয়ম জানানো হবে। বলা হবে, নতুন করে সুপারবিল্টের জন্য কর দেবেন না। ইতিমধ্যেই সুপারবিল্ট ধরে যাঁদের কর মূল্যায়ন হয়েছে, তা ঠিক করে দেওয়া হবে। যা নেওয়া হয়ে গিয়েছে, তা ফেরত দেওয়া বা অ্যাডজাস্ট করার ব্যাপার নেই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy