Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
Health

ন’মাস ধরে হাসপাতালে, অবশেষে বাড়ির পথে তরুণী  

৪৫ দিন কোমায় থাকার পরে ফেরেন ওই তরুণী।

ফেরা: জন্মদিনে অভিষিক্তাকে আদর মা অনিন্দিতা ব্রহ্মের। পাশে রয়েছেন অভিষিক্তার বাবা এবং ভাইও। শনিবার, এসএসকেএমে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

ফেরা: জন্মদিনে অভিষিক্তাকে আদর মা অনিন্দিতা ব্রহ্মের। পাশে রয়েছেন অভিষিক্তার বাবা এবং ভাইও। শনিবার, এসএসকেএমে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

নীলোৎপল বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০২০ ০২:২৫
Share: Save:

শিরদাঁড়া বেঁকে গিয়েছে। ধীরে ধীরে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে বাঁ দিকের ফুসফুস। দু’চোখের দৃষ্টিশক্তিও চলে গিয়েছে বছর পাঁচেক হল। এর মধ্যেই তাঁকে অক্সিজেন নিতে হয় গলার কাছে ফুটো করে লাগানো নল দিয়ে। হাত-পা নাড়ানো তো দূর, গায়ে মাছি বসলেও ওড়াতে পারেন না তিনি।

এই অবস্থায় ন’মাস লড়াইয়ের পরে শুক্রবার সন্ধ্যায় এসএসকেএম হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) থেকে ছাড়া পেলেন বাঁশদ্রোণীর বাসিন্দা, জন্ম থেকেই সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত অভিষিক্তা ব্রহ্ম। এখন থেকে তাঁকে বাড়িতেই অক্সিজেনের সাহায্যে রাখতে বলেছেন চিকিৎসকেরা। ঘটনাচক্রে, শনিবারই ছিল তাঁর জন্মদিন। মেয়ের ১৮তম জন্মদিনে এ দিন অভিষিক্তার বাবা অরিন্দম ব্রহ্ম বললেন, “অভিষিক্তা এক সময়ে ৪৫ দিন কোমায় ছিল। সেখান থেকে লড়াই করে ফিরে এসেছে। এসএসকেএমের চিকিৎসকদের সাহায্যে সিসিইউ থেকেও ন’মাসের লড়াই শেষে ফিরল ও।”

মেয়েকে নিয়ে তাঁর বাবা-মায়ের লড়াইয়ের কাহিনিও সহজ নয়। ২০০০ সালে অরিন্দমবাবু ও তাঁর স্ত্রী অনিন্দিতার বিয়ে হয়। অভিষিক্তার পরে তাঁদের এক ছেলেও হয়। ন’বছরের সেই ছেলে অরুণাদিত্যও ডিমেনশিয়ায় ভুগছে। একা স্ত্রীর উপরে দুই সন্তানের চাপ পড়ছে দেখে এক সময়ে চাকরি ছেড়ে দিতে হয় অরিন্দমবাবুকে। তাঁর কথায়, “চাকরি ছেড়ে ছোট একটা ব্যবসা শুরু করি। মনে হয়েছিল, নিজের মতো কাজ করলে পরিবারকে আর একটু বেশি সময় দেওয়া যাবে। কিন্তু লকডাউনে সেই ব্যবসাও বন্ধ হয়ে গেল। অনেক ভেবে তিন বন্ধু মিলে এখন আমরা পিপিই কিট, মাস্ক, স্যানিটাইজ়ার তৈরির ব্যবসা শুরু করেছি। আর চলছে দুই সন্তানকে নিয়ে লড়াই।”

অরিন্দমবাবু জানান, অসুস্থ হলেই অভিষিক্তাকে বাইপাসের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে চিকিৎসা করাতে হত। কয়েক দিন পরে বাড়ি নিয়ে গেলেই ফের শুরু হত সমস্যা। বাড়িতে অক্সিজেনের ঘাটতি হওয়ায় প্রায়ই তাঁর শরীর নীলচে হয়ে যেত। ২০১৪ সালে এমনই সমস্যার পরে অভিষিক্তাকে তাঁরা ভেলোরে নিয়ে যান। সেখান থেকে ফেরার পরে আবার তাঁকে ভর্তি করাতে হয় বাইপাসের ওই হাসপাতালে। ওই সময়েই হঠাৎ চোখে ঝাপসা দেখতে শুরু করেন অভিষিক্তা। ৪৫ দিন কোমায় থাকার পরে ফেরেন ওই তরুণী।

অরিন্দমবাবু বলেন, “মেয়েকে ফিরিয়ে দিলেও ওর দু’চোখের দৃষ্টি আর ফেরাতে পারেনি হাসপাতাল।” গত অক্টোবরে ফের অবস্থার অবনতি হলে অভিষিক্তাকে বাইপাসের ওই হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। দু’মাস সেখানে ভর্তি থাকার পরে আনা হয় এসএসকেএমে।

অনিন্দিতাদেবী জানান, সিসিইউ-এর পাঁচ নম্বর শয্যায় এক সময়ে ভেন্টিলেশনে রাখা হয় অভিষিক্তাকে। চিকিৎসকদের পাশাপাশি তাঁরা স্বামী-স্ত্রীও মেয়েকে সুস্থ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন প্রতিদিন। তাঁর কথায়, “মেয়েকে আমরা কখনও পুরো ছেড়ে আসিনি। রোজ যেতাম। সকালে এক দফায় ওর বাবা খাইয়ে দিয়ে আসতেন। সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ ওর বাবার সঙ্গে আমি যেতাম। খাওয়ানো, পিঠের পরিচর্যা— কিছুই বাকি রাখিনি। না-হলে এত দিন এক জায়গায় শুয়ে থাকা কোনও রোগীর পক্ষেই সম্ভব নয়।”

অরিন্দমবাবুর দাবি, “হাসপাতালও যথেষ্ট করেছে। তবু আর ক’টা দিন মেয়েকে এসএসকেএমে রাখতে পারলে ভাল হত। আসলে বাড়িতে রাখা কতটা কঠিন, আমরা জানি। তবে লড়াই ছাড়ব না।” এসএসকেএমের সুপার রঘুনাথ মিশ্র বললেন, “অভিষিক্তার সেরিব্রাল পলসি আমরা সারাতে পারব না। তবে অন্য সব সমস্যার জন্য যা যা করণীয়, করা হয়েছে। হাসপাতাল আগামী দিনেও ওর পাশে থাকবে।”

মেয়ের ১৮তম জন্মদিনে পরিকল্পনা কী? স্বামী-স্ত্রী জানান, অভিষিক্তা বিরিয়ানি ভালবাসেন। কিন্তু এই অবস্থায় তাঁকে সে সব দেওয়া যাবে না। তাই তাঁর প্রিয় কেক, পায়েস আর লাড্ডুতেই কাজ সারতে চান তাঁরা। এরই মধ্যে চোখ ভিজে যায় বাবার। অরিন্দমবাবু বললেন, “মেয়ের জন্মের পর থেকেই শুনেছি, এটা নাকি লস্ট কেস! বহু চিকিৎসকও তা-ই বলেছেন। কিন্তু আমি আর ওর মা হাল ছাড়িনি। ছাড়বও না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Health Cerebral Palsy SSKM Hospital
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE