কলকাতা শহরে মাঝেমধ্যেই ঘটে বড় অগ্নিকাণ্ড। এর পরে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে সরকারি তরফে রীতিমতো ঘোষণা করে কমিটি তৈরি হয়। কিন্তু বাস্তবে কাজের কাজ আদৌ হয় কি? জোড়াসাঁকোর মেছুয়ায় একটি হোটেলে অগ্নিকাণ্ডে ১৪ জনের মৃত্যু ফের সামনে এনেছে এই প্রশ্নই।
২০০৮ সালে বড়বাজারের নন্দরাম মার্কেটে আগুন লাগার ঘটনা থেকে শুরু করলে গত এক দশকে বিভিন্ন সময়ে এই শহর বেশ কিছু বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডের সাক্ষী থেকেছে। প্রতিটি বিপর্যয়ের পরে পুলিশ-প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে। প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের পরে পুরসভা-দমকল-পুলিশ-পূর্ত দফতর-সিইএসসি-র আধিকারিকদের নিয়ে কমিটি গঠিত হয়েছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। বাস্তব পরিস্থিতি বলছে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রাথমিক কয়েকটি বৈঠক করার পরেই কমিটির কার্যকারিতা চলে যায় ঠান্ডা ঘরে। কখনও কমিটি গঠনের পরে তাদের তরফে কিছু না কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। তবে সেই সুপারিশ বাস্তবায়িত করার নামগন্ধ দেখা যায়নি কোনও তরফেই।
যেমন, ২০২২ সালে ট্যাংরায় একটি চামড়ার গুদামে ভয়াল অগ্নিকাণ্ডের পরে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে দু’টি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি তৈরি হয়েছিল। লক্ষ্য ছিল, শহরের বিভিন্ন অগ্নিকাণ্ড-প্রবণ এলাকা চিহ্নিত করা, সেখানে থাকা বসতবাড়িতে, কারখানায় অথবা বাজারে অগ্নি-নিরোধক ব্যবস্থা মজবুত করা এবং সর্বোপরি সাধারণ মানুষকে সচেতন করে এমন ঘটনার ঝুঁকি কমানো। সরকারি সূত্রের খবর, ওই দু’টি কমিটির একটিতে আছেন পুর ও নগরোন্নয়নমন্ত্রী তথা কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম, দমকলমন্ত্রী সুজিত বসু, সরকারের সচিব পদমর্যাদার এক আধিকারিক এবং কলকাতার নগরপাল। অন্য কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন দমকলের এডিজি। তাতে সদস্য হিসাবে আছেন কলকাতা পুরসভা, পুলিশ ও দমকলের আধিকারিকেরা।
জোড়া কমিটি তৈরির পরে প্রথম কিছু মাস কয়েকটি বৈঠক হয়েছিল। তার পরে ওই দুই কমিটির কোনও বৈঠকই হয়নি। এই প্রসঙ্গে একটি কমিটির সদস্য, দমকলমন্ত্রী সুজিতকে ফোন করে জানতে চাওয়া হলে তিনি কোনও মন্তব্য করতে চাননি। আর একটি কমিটির নেতৃত্বে থাকা, দমকলের এডিজি নীলাদ্রি চক্রবর্তী বলেন, ‘‘যৌথ কমিটি ছ’মাস কাজ করেছিল। তবে দমকলের অডিটের কাজ থেমে থাকেনি। জোড়াসাঁকোর যে হোটেলে আগুন লেগেছিল, সেখানে আমরা অডিট করেছিলাম। একাধিক অগ্নি-নিরোধক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে নির্দেশ দিয়েছিলাম। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা কাজ করেনি। হোটেল কর্তৃপক্ষ আমাদের নির্দেশাবলী মেনে চললে এই বিপদ হত না।’’ এডিজি-র দাবি, ‘‘এই কমিটিগুলি যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে কাজ করে। কিন্তু মানুষ সচেতন না হলে মুশকিল।’’ তবে তিনি এ-ও মেনে নিয়েছেন, সাধারণ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ করার এক্তিয়ার দমকলের হাতে নেই।
এমনিতেই বড়বাজার, জোড়াসাঁকো এলাকায় একাধিক বহুতলে বাণিজ্যিক কাজ চলার পাশাপাশি বহু মানুষ বসবাসও করেন। বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি উপযুক্ত অগ্নি-নিরোধক ব্যবস্থা না করলে তাদের ট্রেড লাইসেন্স বাতিল হবে বলে অতীতে প্রশাসনের তরফে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছিল। কয়েকটি বহুতলের মালিককে গ্রেফতারও করেছিল পুলিশ। কিন্তু কঠোর পদক্ষেপ কখনওই স্থায়ী হয়নি। প্রশাসনের একাংশ বলছেন, যারাই রাজ্যে ক্ষমতায় থাক, বড়বাজার, জোড়াসাঁকোর ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার রাজনৈতিক সদিচ্ছা কেউই সে ভাবে দেখাতে পারেনি। ফলে, ওই অঞ্চল রয়েছে জতুগৃহ হয়েই।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)