প্রতীকী ছবি।
তার যখন মাত্র এক বছর ১০ মাস বয়স, তখন গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন বাবা। মাস ছয়েক আগে বিষ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন মা-ও। ছোট্ট মেয়ের মনে এই ঘটনাগুলো গভীর রেখাপাত করেছিল। মনোরোগ চিকিৎসকেরা বলছেন, জীবনের এই ঘটনাগুলিই হয়তো চতুর্থ শ্রেণির ওই পড়ুয়াকে শিখিয়েছিল ‘আত্মহত্যা’র অর্থ কী। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বাবা-মার থেকে ভালবাসা না পাওয়ার কষ্ট। তাই হয়তো ওই পড়ুয়ার মনে হয়েছিল যে, এই সমস্যা থেকে মুক্তির একমাত্র পথ আত্মহত্যা!
কোদালিয়ার এই ঘটনায় অবশ্য ইতিমধ্যেই শোরগোল পড়ে গিয়েছে। যদিও মনোরোগ চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, এটি একেবারে বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। তবে এত ছোট মেয়ের আত্মহত্যার পদ্ধতি সম্পর্কে জেনে ফেলা আদতে সমাজকেই বড় প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায় বলে মনে করছেন সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘ভাবলেই আতঙ্কিত লাগছে। যথেষ্ট উদ্বেগের ব্যাপার। সামাজিক বন্ধন কোন জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালে এমনটা হতে পারে, তা ভাবতেই পারছি না।’’
মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেব বলছেন, ‘‘নানা ভাবে অত্যাচারিত হতে হতে হয়তো আত্মহত্যাকেই মুক্তির পথ ভেবেছিল বাচ্চা মেয়েটা। কিন্তু প্রশ্ন হল, আত্মহত্যা কী, এই বয়সে সেটা সে বুঝল কী করে?’’ অনিরুদ্ধবাবুর দাবি, পরিবারেই আত্মহত্যার পূর্ব-ইতিহাস থাকায় হয়তো এ নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছিল মেয়েটির মধ্যে। অনিরুদ্ধবাবুর কথায়, ‘‘পরিবারে আত্মহত্যার একটা ব্যাপার থাকায় হয়তো তা থেকেই সে শিখেছে। যখন বাবার মৃত্যু হয়, তখন ও অনেক ছোট। তবে শুনেছে হয়তো। মায়ের আত্মহত্যার চেষ্টা ওর মনে গেঁথে বসে গিয়েছে।’’
আরও পড়ুন: ‘মরতে চাই!’ ওষুধভর্তি শিশি দেখিয়ে বন্ধুদের বলেছিল চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রীটি
মনোরোগ চিকিৎসক রিমা মুখোপাধ্যায় আবার শুধু বাবা-মায়ের উপরেই দোষ চাপাতে চান না। তাঁর মতে, ‘‘একটা শিশুর বসবাসের উপযোগী একটা সমাজও কী আমরা আদৌ দিতে পারছি? সব দিক থেকে কোণঠাসা হয়ে পড়লে তবেই কেউ এই পথ বেছে নেয়। স্কুলের চাপও কি এ ক্ষেত্রে একদমই নেই? অনেক ক্ষেত্রে তো স্কুলের চাপে শিশু অনেক ভুল পথ নেয়।’’ প্রসঙ্গত, বছর খানেক আগেই হাওড়ার গোলাবাড়ি থানা এলাকায় পাঁচতলা বাড়ির ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল ষষ্ঠ শ্রেণির এক পড়ুয়া। বেশ কয়েকটি হাড় ভেঙে হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয়েছিল প্রায় তিন মাস। পরিবারের অভিযোগ ছিল, স্কুলে নগ্ন করে ছেলেটিকে মারধর করা হয়েছিল। সেই অপমানেই স্কুল থেকে ফেরার পথে একটি বাড়ির ছাদ থেকে ঝাঁপ দেয় সে। বুধবার সেই ছাত্রের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেল, সম্প্রতি অন্য একটি স্কুলে ভর্তি হয়েছে সে। তবে এখনও ঠিক মতো হাঁটতে পারে না।
সোনারপুরের খুদে পড়ুয়ার ঘটনা প্রসঙ্গে মনোরোগ চিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম অবশ্য পরিবারের দিকেই আঙুল তুলছেন। তাঁর মতে, ‘‘আমরা পরিবারকে মাথায় তুলে রাখি। আর পরিবারের মধ্যে থেকেই এই ধরনের অভিযোগ বেশি ঘটে।’’ বেথুন স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা শাশ্বতী অধিকারী বলছেন, ‘‘বাবা-মায়ের থেকে ভালবাসা আশা করে শিশুরা। দোষ আমাদেরই, ওদের উপযুক্ত জীবন দিতে পারছি না। এই মেয়েটিও তারই শিকার।’’
গত এপ্রিলে পূর্বাচল-কালিকাপুর রোডের একটি আবাসন থেকে পার্ক স্ট্রিটের একটি নামী কলেজের ছাত্রের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়েছিল। পরিবারের একাংশের অভিযোগ ছিল, জার্মানিতে কর্মরত ওই ছাত্রের দাদার সঙ্গে তুলনা করে প্রায়শয়ই বকাবকি করা হতো ওই কলেজপড়ুয়াকে। পরীক্ষার সপ্তাহখানেক আগেও তাঁকে একইভাবে বকাবকি করা হয়। সেই অভিমানেই তিনি আত্মঘাতী হন বলে অভিযোগ। এই ধরনের ঘটনা এড়াতে তাই ছোটদের সঙ্গে সময় কাটানোর পরামর্শ দিচ্ছেন জয়রঞ্জনবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘যে কেউ, বিশেষ করে ছোটরা তাঁদের সমস্যার কথা একবারই বড়দের বলে। সেই সময়ে তাদের কথা মন দিয়ে শোনা দরকার। ভালবাসা দরকার। না হলে অনেক দেরি হয়ে যায়।’’
শীর্ষেন্দুবাবুও বলছেন, ‘‘বাচ্চা মেয়েটা পরিবারের থেকে ভালবাসা চাইছিল। সেটুকুও না দিতে পারার অবক্ষয়ের দিকে এগোচ্ছি আমরা।’’
কলকাতার এই মুহূর্তের শিরোনাম কী - জানতে চোখ রাখুন আনন্দবাজার পত্রিকার কলকাতা বিভাগে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy