Advertisement
০২ মে ২০২৪
Jadavpur University Student Death

যাদবপুরের হস্টেলে টবে গাঁজা চাষের ‘প্রমাণ’ পেল পুলিশ! ছাত্রমৃত্যুতে আরও ১৪ জনকে থানায় জেরা

যাদবপুরকাণ্ডে র‌্যাগিংয়ের প্রমাণ পেয়েছে রাজ্য মানবাধিকার কমিশনও। ছাত্রমৃত্যুর ঘটনার মঙ্গলবারই কমিশনকে রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কমিশনের হাতে তুলে দেওয়া হয় ৩০টিরও বেশি ফাইল।

Police interrogated 14 more people in connection with the death of a student in Jadavpur University

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০২৩ ২৩:১৮
Share: Save:

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের এক পড়ুয়ার মৃত্যুর ঘটনায় মেন হস্টেলের ‘র‌্যাগিং সংস্কৃতি’ নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত। তার মধ্যেই হস্টেল আবাসিকদের ‘উচ্ছৃঙ্খল’ জীবনযাপন, মদ-গাঁজার আসর বসানো, রাতভর নাচ-গান, চিৎকার-চেঁচামেচি, আশপাশের মেয়েদের দেখে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি— এ সব নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে শিক্ষা মহলে। এই আবহে হস্টেলের ঘরে গাঁজা চাষেরও প্রমাণ পেল পুলিশ!

ছাত্রমৃত্যুর তদন্তে নেমে পুলিশ ধৃতদের ফোন বাজেয়াপ্ত করেছে। ফরেন্সিকে পাঠানো হয়েছিল সেই সব ফোন। তদন্তকারীদের সূত্রে জানা গিয়েছে, ফরেন্সিক পরীক্ষায় সেই ফোনগুলির একটিতে হস্টেলের ঘরে টবে গাঁজা চাষের ছবি মিলেছে। গত ৯ অগস্ট হস্টেলে নবাগত এক পড়ুয়ার মৃত্যুর ঘটনার পর সেই ছবি ফোন থেকে মুছে ফেলা হয়েছিল। পুলিশ সূত্রে খবর, মর্মান্তিক ওই ঘটনার পর অভিযুক্তদের কারও ফোন থেকে কোনও ছবি, ভিডিয়ো বা চ্যাট (কারও সঙ্গে কথোপকথন) মোছা হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

একই সঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদ-পর্বও জারি রেখেছেন তদন্তকারীরা। বুধবার যাদবপুর থানায় মোট ১৪ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের তিন পড়ুয়া রয়েছেন। এ ছাড়াও রয়েছেন মেস কমিটির চার সদস্য এবং হস্টেলের ক্যান্টিনের সাত জন। মঙ্গলবার লালবাজারে ডেকে পাঠানো হয়েছিল যাদবপুরের মেন হস্টেলের ক্যান্টিনের রাঁধুনিকে। ঘটনার রাতে বা তার আগে মেন হস্টেলে কী হয়েছিল বা হত, তা নিয়ে এর আগে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে মুখ খুলেছিলেন ওই রাঁধুনি। জানিয়েছিলেন, হস্টেলে প্রথম বর্ষের ছাত্রদের উপর হওয়া অত্যাচারের কথা। পুলিশ সূত্রে খবর, রাঁধুনির বয়ানে র‌্যাগিংয়ের প্রমাণ মিলেছে। সেই বয়ানের সত্যতা যাচাইয়ের জন্যই ক্যান্টিনের অন্য কর্মচারীদের ডেকে পাঠানো হয়েছে বলে খবর তদন্তকারীদের সূত্রে। ওই সূত্রের বক্তব্য, ক্যান্টিনে যে হেতু সব ছাত্রেরই অল্পবিস্তর যাওয়া-আসা থাকে, সেই জন্য ছাত্রদের পারস্পরিক কথাবার্তা বা আচরণ চোখের সামনে দেখতে পান তাঁরা। তা ছাড়া হস্টেল সংলগ্ন হওয়ায় বিভিন্ন ঘটনাও ক্যান্টিন কর্মীদের চোখে পড়ে থাকতে পারে। ঠিক যেমন রাঁধুনির চোখে পড়েছিল!

যাদবপুরকাণ্ডে র‌্যাগিংয়ের প্রমাণ পেয়েছে রাজ্য মানবাধিকার কমিশনও। ছাত্রমৃত্যুর ঘটনার মঙ্গলবারই কমিশনকে রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কমিশনের হাতে তুলে দেওয়া হয় ৩০টিরও বেশি ফাইল। এর পর ঘটনার রিপোর্ট এবং সাক্ষীদের বয়ান খতিয়ে দেখতে শুরু করে কমিশনের নিজস্ব তদন্তকারী দল। কমিশন সূত্রে খবর, অনেকের বয়ানেই র‌্যাগিংয়ের প্রমাণ মিলেছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার স্নেহমঞ্জু বসু বলেন, ‘‘যে রিপোর্ট চাওয়া হয়েছিল, তার পুরোটাই আমরা জমা দিয়ে দিয়েছি। কমিশন আমাদের র‌্যাগিংয়ের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে বলে কিছু জানায়নি।’’ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে রিপোর্ট তলব করেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও। রেজিস্ট্রার জানান, বুধবার সেই রিপোর্ট পাঠানো হবে।

অন্য দিকে, বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটির মুখোমুখি হন ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় নাম জড়িয়ে পড়া অরিত্র মজুমদার ওরফে ‘আলু’। দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পৌঁছে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে অরিত্র বলেন, ‘‘আমি চাই দোষীরা চিহ্নিত হোক। এখন যে হেতু তদন্ত প্রক্রিয়া চলছে, তাই এর বেশি আমি কিছু বলব না।’’ মঙ্গলবার মধ্যরাত পর্যন্ত যাদবপুর থানায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল অরিত্রকে। ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা যোগসাজশের দাবির প্রেক্ষিতে অরিত্র পাল্টা যা দাবি করেছেন সমাজমাধ্যমে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। প্রশ্ন উঠেছে, ঘটনার পরের দিন, অর্থাৎ ১০ অগস্ট কাশ্মীরের উদ্দেশে রওনা দেওয়ার পরেও কী ভাবে ১১ অগস্ট ‘অ্যাটেনডেন্স রেজিস্টার’-এ অরিত্রের সই রয়েছে। সেই প্রসঙ্গে সংবাদমাধ্যমে অরিত্রের দাবি, একসঙ্গে তিন দিনের সই করতে গিয়ে ভুল করে ১১ তারিখের ঘরে সই করে ফেলেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে খবর, অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি অরিত্রের কাশ্মীর যাত্রার ট্রেন এবং বিমানের টিকিট খতিয়ে দেখেছে। ‘অ্যাটেনডেন্স রেজিস্টারে’ ১১ তারিখের পাশে তাঁর সই কী ভাবে এল, সেই বয়ানও সংগ্রহ করা হয়েছে।

যাদবপুরে সিসি ক্যামেরা

অবশেষে সিসি ক্যামেরা বসানোর প্রক্রিয়া শুরু হল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ইতিমধ্যেই প্রয়োজনীয়তা এবং গুরুত্ব বিচার করে ‘স্ট্র্যাটেজিক পয়েন্ট’ চিহ্নিত করা হয়ে গিয়েছে বলে জানিয়েছেন উপাচার্য বুদ্ধদেব সাউ। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে খবর, যত দ্রুত সম্ভব এই ‘স্ট্র্যাটেজিক পয়েন্টে’ সিসি ক্যামেরা বসানোর কাজ শেষ হবে। এমনকি, যে জায়গাতে সিসি ক্যামেরায় কাজ হবে না, সেখানে তার পাশাপাশি নিরাপত্তারক্ষীও মোতায়েন করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। বুধবারই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন উপাচার্য। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের কোন কোন জায়গাকে ‘স্ট্র্যাটেজিক পয়েন্ট’ হিসাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, মেন হস্টেল বা অন্য হস্টেলে সিসি ক্যামেরা বসবে কি না সে বিষয়ে বিশদে জানান উপাচার্য। তিনি বলেন, ‘‘মেন হস্টেল এবং অন্যান্য হস্টেলের মেন গেটেও সিসি ক্যামেরা লাগানো হবে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বেশ কিছু জায়গাকে সিসি ক্যামেরা লাগানোর জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে।’’ ইতিমধ্যেই ওয়েবেলের সঙ্গে সিসি ক্যামেরা লাগানোর ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যোগাযোগও করেছেন বলে জানান তিনি। তবে একই সঙ্গে উপাচার্য এ-ও জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে আর কোথায় কোথায় সিসি ক্যামেরা বসবে সে ব্যাপারে এগজ়িকিউটিভ কাউন্সিলের (ইসি) বৈঠকের পরেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা ইউজিসি নির্দেশিকা অনুযায়ীই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নজরদারির ব্যাবস্থা রাখতে হয়। কিন্তু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে দীর্ঘ চেষ্টার পরেও অধিকাংশ এলাকায় সিসি ক্যামেরা বসানো যায়নি। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের তথাকথিত ‘নেতা’দের দায়ী করেছিল একটি মহল। তারা এমনও বলেছিল, এঁদের কাছে বাধা পেয়েই যাদবপুর ক্যাম্পাসে প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও সিসি ক্যামেরা বসানো যায়নি। কিন্তু গত ৯ অগস্টের ঘটনার পর এই সিসি ক্যামেরা না থাকা নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে। তার পরেই যাদবপুরের ছাত্রমৃত্যুর ঘটনার প্রায় ১৩ দিনের মাথায় শুরু হল যাদবপুরে সিসি ক্যামেরা বসানোর প্রক্রিয়া। তবে নজরদারির জন্য শুধু সিসি ক্যামেরা নয় আরও বেশ কিছু বিকল্প ভেবেছেন বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বুদ্ধদেব।

মেজাজ হারালেন বুদ্ধদেব

ক্যাম্পাসে সিসি ক্যামেরার নজরদারি নিয়ে তাঁর পরিকল্পনার ব্যাপারে সবিস্তারে জানতে চাওয়া হয়েছিল। জবাবে বুদ্ধদেব বলেন, ‘‘নজরদারি তো অবশ্যই প্রয়োজন। ইউজিসি-র নির্দেশিকাতেই তেমন বলা আছে। কিন্তু নজরদারি কি শুধু সিসি ক্যামেরাতেই হতে হবে। এমন অনেক জায়গা আছে যে খানে সিসি ক্যামেরার নজরদারিও যথেষ্ট নয়। সে সমস্ত জায়গায় নিরাপত্তারক্ষী রাখার কথাও মাথায় আছে আমাদের। এ ছাড়া বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থার পরামর্শ নিতে পারি।” এমনকি, বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে আরএফআইডি অর্থাৎ রেডিয়ো ফ্রিকোয়েন্সি আইডেন্টিফিকেশনের ব্যবস্থা করা যায় কি না সে ব্যাপারেও ভাবনাচিন্তা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন উপাচার্য। ঠিক কোথায় কোথায় সিসি ক্যামেরা লাগানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে— আনন্দবাজার অনলাইনের এই প্রশ্নে মেজাজ হারাতে দেখা গেল নতুন উপাচার্যকে। বিরক্তি প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘‘বার বার একই প্রশ্ন? আমি কি সব মুখস্থ করে রেখে দিয়েছি?’’ তাঁর জবাব, ‘‘এর জন্য রিকোয়্যারমেন্ট অ্যানালিসিস দরকার। আগে তো অ্যানালিসিস করতে হবে। আগে শুনেছি একটা প্ল্যান হয়েছিল, সেই সব প্ল্যান খুঁজে দেখতে হবে। এমনিতেও প্রাথমিক ভাবে কিছু স্ট্র্যাটেজিক পয়েন্টে সিসি ক্যামেরা বসানো হবে। তবে একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ পরিকাঠামোর জন্য সব দিক খতিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE