বছর তিনেক আগে নজরুল মঞ্চে কলকাতার একটি কলেজের অনুষ্ঠানের পরে বলিউডি তারকা গায়ক কেকে-র মৃত্যু ঘিরে নানা প্রশ্ন উঠেছিল। মর্মান্তিক সেই ঘটনায় রাজ্যের শিক্ষাজগতের হিংস্র নৈরাজ্যের দিকে আঙুল ওঠে। শোনা যায়, ‘পাস’ ছাপিয়ে নজরুল মঞ্চে হাজার দুয়েক বাড়তি দর্শক ঢুকিয়ে দম বন্ধ করা পরিবেশ সৃষ্টি হয়। কিছু ‘পাস’ বিক্রিও হয়। এ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সেই কলেজ, স্যর গুরুদাস মহাবিদ্যালয়ের টিএমসিপি ইউনিটের তখনকার নেতা তথা প্রাক্তনী, এখনও কলেজের অস্থায়ী শিক্ষাকর্মী পঙ্কজ ঘোষ পাল্টা প্রশ্ন করেন। বলেন, ‘‘কেকে-র শোয়ের প্রবেশপত্রে তো ‘নট ফর সেল’ লেখা ছিল। ছাত্ররাই কেউ ‘পাস’ বিক্রি করেছে, এটা কী করে জানা গেল!’’ বিষয়টি হাই কোর্টে বিচারাধীন, মনে করাচ্ছেন তিনি।
তবে শিল্পে পিছিয়ে থাকা রাজ্যের কলেজগুলি যে এখন সর্বতোভাবে টাকা রোজগারের কলকারখানা হয়ে উঠেছে, তা প্রায় অবিসংবাদিত সত্যের চেহারা নিয়েছে। কলকাতার নামী কলেজ থেকে শুরু করে অখ্যাত মফস্সল বা প্রান্তিক জেলায় এই কলেজ-অর্থনীতির চরম আগ্রাসী চেহারাটাই দগদগে। কলকাতার একাধিক কলেজে পোড়খাওয়া এক অধ্যক্ষ বলছেন, “কলেজের ভোটাভুটিহীন ছাত্র সংসদে ইউনিয়নতন্ত্রের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে না পারলে ভয়ানক খেসারত দিতে হবে। ইউনিয়ন বা অন্য প্রভাবশালী মহলের দাবিদাওয়া না মানলে পরিচালন সমিতিই (জিবি) অনেক সময়ে অধ্যক্ষের উপরে চাপ দেবে। তার পরেও বেশি জেদ দেখালে অধ্যক্ষের সাসপেন্ড (নিলম্বিত) হওয়া অনিবার্য। এর পরে টিচার ইনচার্জ বা ভাইস প্রিন্সিপালকে দিয়ে কলেজ চলবে। অধ্যক্ষ বেচারি মামলা করে মাথা খুঁড়বেন। এটাই সিস্টেম।”
দক্ষিণ কলকাতার চারুচন্দ্র কলেজ, বর্ধমানের রাজ কলেজ এবং পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর কলেজের এই দিক দিয়ে মিল চোখে পড়ার মতোই। চারুচন্দ্রের অধ্যক্ষ সত্রাজিৎ ঘোষ ২০১৮ সালে, রঘুনাথপুরের অধ্যক্ষ ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় বছর দুই আগে এবং বর্ধমান রাজ কলেজের নিরঞ্জন মণ্ডল কয়েক মাস আগে সাসপেন্ড হয়েছেন। চারুচন্দ্রে তৎকালীন জিবি সভাপতি শিবরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় সত্রাজিৎকে ২০১৮ সালে ইমেলে নিলম্বিত করার পরে হাই কোর্টে যান তিনি। হাই কোর্ট বার বার বলা সত্ত্বেও এখনও সেই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ হয়নি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রবীণ অধ্যাপক শিবরঞ্জন এখনও চারুচন্দ্রের জিবি-তে সরকার মনোনীত সদস্য। যোগমায়া দেবী কলেজে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাস্টারমশাই থাকার কথা বলেন তিনি। শিবরঞ্জনই সাউথ ক্যালকাটা ল কলেজের এক জন জিবি সদস্য। সেখানেও মনোজিৎ মিশ্রের মতো দুর্বৃত্তকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
চারুচন্দ্র প্রসঙ্গে শিবরঞ্জনের ব্যাখ্যা, “অধ্যক্ষ জিবি-র সঙ্গে পদে পদে সংঘাত সৃষ্টি করতেন। তথ্যানুসন্ধান কমিটির প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উনিই হাই কোর্টে যান।” সত্রাজিতের দাবি, চারুচন্দ্রে ২০১৬-২০১৮ অধ্যক্ষ থাকাকালীন ভুলভাল খরচ কমিয়ে বিপুল টাকা সাশ্রয় করে কলেজের তহবিল ৬ লক্ষ থেকে দেড় কোটিতে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর কথায়, “কলেজের সোশালের নাম করে যে টাকা চাওয়া হত, তা তহবিলে থাকত না। অন্য বরাদ্দ থেকে টাকা সরিয়ে তা দিতে চাপ দেওয়া হত। এমনও হয়েছে ছোটখাটো ইলেকট্রিকের মেরামতির জন্য ৫০-৬০ হাজার চাওয়া হয়েছে, আমি তা দেড় হাজারে সারিয়ে ফেলেছি। এ সব করেই অনেককে চটিয়ে ফেলেছি এবং খেসারত দিচ্ছি।”
বর্ধমান রাজ কলেজে গায়িকা নিকিতা গান্ধীর অনুষ্ঠান ঘিরেও অধ্যক্ষ নিরঞ্জনের (অধুনা নিলম্বিত) সঙ্গে জেলার টিএমসিপি নেতৃত্বের সংঘাত তৈরি হয় বলে অভিযোগ। নিরঞ্জন বলেন, “অনুষ্ঠানটির ভার যাঁদের দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের সঙ্গে জেলার এক বড় ছাত্রনেতার কিছু যোগ ছিল। ঠিকঠাক রসিদ ছাড়াই ১৬-১৭ লক্ষ টাকা চাইছিলেন ওঁরা। সেটার বিরোধিতা করেই বিরাগভাজন হই।” অধ্যক্ষের দাবি, নানা মিথ্যা অভিযোগ তুলে তাঁকে সাসপেন্ড করা হয়।
বর্ধমানের টিএমসিপি সভাপতি স্বরাজ ঘোষ অবশ্য বলেন, “কলেজের অনুষ্ঠান নিয়ে সংঘাতে সাসপেন্ড করা হলে তো গত বছরই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ হত। ওঁকে অন্য সব গাফিলতির গুরুতর অভিযোগে সাসপেন্ড করা হয়েছে। আমাদের নাম অহেতুক জড়ানো হচ্ছে।” রঘুনাথপুরের কলেজেও ওয়েবকুপার জেলা নেতৃত্বের ঘনিষ্ঠ, তৎকালীন জিবি সভাপতির সঙ্গে সংঘাতে অধ্যক্ষ সাসপেন্ড হন বলে অভিযোগ। তবে তিনি কিছু বলতে চাননি।
রাজ্যে কলেজগুলির বেশির ভাগের কার্যত শাসক দলের পার্টি অফিস হয়ে ওঠার কথা বলছেন অনেক অধ্যক্ষই। বর্ধমানের রাজ কলেজে গ্রুপ সি শিক্ষাকর্মী নেই। আট জন মাত্র গ্রুপ ডি কর্মী। বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই অস্থায়ী কর্মীদের নিয়োগ এবং তাঁদের অনিয়মের দেদার অভিযোগ। বেশির ভাগ কলেজেই এটাই রীতি। কসবা-কাণ্ডের পরে যা 'মনোজিৎ মডেল' আখ্যা পেয়েছে। কলেজের জিবি-কে জানিয়েও সচরাচর লাভ হয় না। কারণ, সেখানে শাসক দলের মুখেরাই মনোনীত সভাপতি। শাসক দলের ঘনিষ্ঠদেরই জিবি-তে রমরমা। অবশ্য এ বিষয়ে মন্তব্যই করতে চাননি শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু ।
(চলবে)
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)