E-Paper

‘দাদু থাকলে ঠিক সাইকেলে চাপিয়ে ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যেত’

কোথাও জমা জলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে, কোথাও বা জমা জলে ডুবে পুজোর মুখে প্রাণ গিয়েছে অনেকের। তাঁদের পরিবার কেমন আছে, খোঁজ নিল আনন্দবাজার।

নীলোৎপল বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৮:৪৯
একবালপুরে জিতেন্দ্র সিংহ যেখানে মারা যান, সেই অংশটি ঘিরে রেখেছে বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা।

একবালপুরে জিতেন্দ্র সিংহ যেখানে মারা যান, সেই অংশটি ঘিরে রেখেছে বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।

মাইকে ভেসে আসছে ঢাকের আওয়াজ, মণ্ডপে ভিড় না-করার ঘোষণা। বছর দশেকের মেয়ে বাবা, মা, ঠাকুরমার কাছে ঠাকুর দেখতে নিয়ে যাওয়ার জন্য বায়না করে চলেছে। কিন্তু পরিবারে আকস্মিক মৃত্যুএখনও ধাতস্থ হতে দেয়নি তাঁদের। শোকগ্রস্ত মনকে ছুঁতে পারছে না ছোট্ট মেয়ের বায়না। মেয়ে এ বার বলল, ‘‘অন্তত বন্ধুদের সঙ্গে যাই। তোমরা কেউ নিয়ে যাও না। দাদু থাকলে ঠিক সাইকেলে চাপিয়ে ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যেত।’’

নীল রঙের ছোট মাপের সাইকেলটা এখনও পড়ে বাড়ির সদর দরজার পাশে। কিন্তু তাতে চড়ে সকাল-বিকেল ঘুরে বেড়ানো, বালিকার দাদু প্রাণতোষ কুণ্ডু আর নেই। নেতাজিনগর বাস স্ট্যান্ডের কাছে জলে ডুবে থাকা ফলের দোকান সামলাতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে তাঁর মৃত্যু হয় দ্বিতীয়ার ভোরে। ওই দিনই শহরের নানা প্রান্তে আরও বেশ কয়েক জনের মৃত্যু হয় একই ভাবে— জমা জলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে। কাউকে ভাসতে দেখা যায় বাড়ির উঠোনে, কেউ আবার বস্তির শৌচাগারে যাওয়ার পথে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েছিলেন।

পুজোয় আপনজনদের হারানো সেই পরিবারগুলির খোঁজ করা হচ্ছিল পঞ্চমীর সকালে। প্রাণতোষের পুত্রবধূ সোনিয়া কুণ্ডু বললেন, ‘‘আমাদের পুজো দ্বিতীয়াতেই শেষ হয়ে গিয়েছে। এমন অসহায় কখনও লাগেনি। বাবাকে ওই অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেও কিছু করতে পারিনি। মাইকের আওয়াজে এখন রাগ হচ্ছে। যারা এই ভাবে আমাদের সব আনন্দ শেষ করল, তাদের যেন বিচার হয়। আর যেন কারও সঙ্গে এমন না হয়।’’

একবালপুরে বাড়ির সামনেই জমা জলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন বছর ষাটেকের জিতেন্দ্র সিংহ। গলি, তস্য গলি পেরিয়ে বাড়িতে পৌঁছে জানা গেল, জিতেন্দ্র গাড়ি চালাতেন। বড় ছেলে এ জে সি বসু কলেজে বাণিজ্য বিভাগের পড়ুয়া। ছোট ছেলে উচ্চ মাধ্যমিক দেবে। দুই ছেলে এবং স্ত্রীকে নিয়ে সংসারে জিতেন্দ্রই ছিলেন একমাত্র রোজগেরে। যে ঘরে তাঁরা ভাড়া থাকতেন, তা ভেঙে বহুতল উঠছে। ফলে, অন্যত্র ভাড়ায় রাখা হয়েছিল তাঁদের। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বহুতল উঠলেও নিরাপত্তার বন্দোবস্ত নেই এলাকায়। এখনও মিটার থেকে ঝুলছে খোলা তার, যেমন খুশি বিদ্যুৎ নিয়ে যাওয়া হয়েছে তার দিয়ে। সেখানকারই বাসিন্দা রুবি দেবী বললেন, ‘‘বৃষ্টি হলেই এখানে হাঁটু সমান জল জমে যায়। তার মধ্যে কোথায় কী তার পড়ে থাকে, কেউ জানে না। সে দিনও শৌচাগারে যাওয়ার জন্য বেরিয়েছিলেন জিতেন্দ্র। ভোরে আমার স্বামী বেরিয়ে দেখেন, তাঁর দেহ ভাসছে। ধরতে গেলে স্বামীও বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন।’’ জানা গেল, জিতেন্দ্রর বাড়ি গিয়েছিলেন কলকাতার মেয়র। বিদ্যুৎ সংস্থা সিইএসসি এবং রাজ্য সরকারের তরফে আর্থিক সাহায্য করার কথা দিয়ে এসেছেন তিনি। জিতেন্দ্রর বড় ছেলে প্রিয়াংশু সিংহ ফোনে বলেন, ‘‘মেয়রের কথা মতোই বিহারের সিওয়ান জেলায় বাবার শেষকৃত্য করতে এসেছি আমরা। যে ভাবে আমাদের থাকতে হয়, তাতে যে কোনও দিন এমন বিপদ ঘটতে পারত। বাবা তো আর ফিরবে না, মেয়র সাহেবকে জানিয়েছি, যাতে এলাকাটার পরিস্থিতি একটু ভাল হয়।’’

জমা জলে প্রাণ গিয়েছে বালিগঞ্জ প্লেসের বাসিন্দা সন্দীপ গুহঠাকুরতারও। ওই এলাকায় একটি বাড়ির নীচে ভাড়ায় থাকতেন তিনি। সেখানে পৌঁছে দেখা গেল, তাঁর ঘরের বাইরে এখনও আলো জ্বলছে। প্রত্যক্ষদর্শী প্রতিবেশীরা জানাচ্ছেন, প্রৌঢ় সন্দীপ ওই ঘরে একাই থাকতেন। জমা জলের মধ্যে কোনও কারণে বেরোতে যাচ্ছিলেন। পড়ে গিয়ে সম্ভবত আর উঠতে পারেননি। বেলার দিকে তাঁকে জলের মধ্যে ভাসতে দেখা যায়।

বাবাকে জলে ভাসতে দেখার কথা জানাতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠেন প্রাণতোষের পুত্র, বেসরকারি সংস্থার কর্মী দোলন কুণ্ডু। তিনি বলেন, ‘‘কুড়ি-পঁচিশ বছর ধরে বাবা সকাল-বিকেল দোকানে যেতেন। বৃষ্টির মধ্যে দোকানটা বাঁচাতেই বেরিয়েছিলেন। সাইকেল রাখতে গিয়েই বাবা জলে পড়ে যান। আর ওঠেননি। খবর পেয়ে গিয়ে আমরা দু’ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। বাবা ওই অবস্থায় পড়ে আছেন দেখেও বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হতে পারি বলে কাছে ঘেঁষতে দেওয়া হয়নি।’’ গলা বুজে আসে বছর বিয়াল্লিশের দোলনের। কোনও মতে বলেন, ‘‘ঢাকের আওয়াজ, পুজোর গান আর ভাল লাগছে না। সাইকেলের বেলের আওয়াজ কানে গেলেই শুধু মনে হচ্ছে, বাবা আসবে হয়তো।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Durga Puja 2025 Drainage Trouble Electrocuted

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy