গত বছর মেয়ে বলেছিল, ‘মা, কমলা রঙের বোগেনভিলিয়ার গাছটা আনতে হবে।’ না, বাড়ির ছাদের বাগানে সেই গাছ আর আনতে পারেননি আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের তরুণী পড়ুয়া-চিকিৎসক। রবিবার তাঁর ৩২ বছরের জন্মদিনে সেই গাছের চারা টবে পুঁতলেন মা। বললেন, ‘‘জন্মদিনে তো ওকে আর কিছু দিতে পারব না। তাই ওর যেটা ইচ্ছা ছিল, সেটা পূরণ করলাম।’’
ছোট থেকেই গাছ ভালবাসতেন তরুণী। তাই নিজে পছন্দ করে কিনে আনতেন বিভিন্ন গাছের চারা। মেয়ের নিয়ে আসা সেই চারা পরিচর্যা করে বড় করে তুলতেন মা। এ দিন সেই কথা বলতে গিয়ে বার বার তাঁর চোখের কোণ চিকচিক করে উঠছিল। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘‘বিভিন্ন রঙের জবা ফুল পছন্দ করত মেয়েটা। ছাদে অনেক জবা ফুলের গাছ আছে। এ ছাড়াও অর্কিড, বোগেনভিলিয়া-সহ আরও গাছ আছে। সবই মেয়ের নিয়ে আসা।’’ রাস্তায় থেকে ন্যায় বিচারের লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মধ্যে দিয়েই এ দিন মেয়ের জন্মদিন পালন করতে চেয়েছিলেন বাবা-মা। তাই মেয়ের ছবিতে কোনও মালা দেওয়া নয়। বরং মনের কষ্ট চেপে সাধারণ মানুষকে আরও এগিয়ে আসার বার্তা দিলেন তাঁরা।
বেলা ১২টার সময়ে জন্ম হয়েছিল তাঁদের একমাত্র মেয়ের। এ দিন ঘড়ির কাঁটায় সেই সময়টা আসতেই, মেয়ের স্মৃতিতে হওয়া স্বাস্থ্য শিবিরের সামনে দাঁড়িয়ে বাবা-মা দাবি তুললেন, ‘‘আমাদের সব শেষ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ওর আজকের জন্মদিন থেকে ন্যায় বিচারের লড়াইটা আরও জোরদার হয়ে উঠুক।’’ তরুণী চিকিৎসকের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরেই তাঁদের পৈতৃক বাড়ি। সেখানেই জন্মের পর থেকে প্রায় ১৪টা বছর কেটেছিল। এ দিন সেই বাড়ির যে ঘর, বারান্দায় ছোট্ট মেয়ে আস্তে আস্তে বড় হয়েছিল, সেখানে কিছু ক্ষণ সময় কাটান বাবা-মা। সঙ্গে যান কয়েক জন জুনিয়র চিকিৎসক, অভয়া মঞ্চের কয়েক জন সদস্যও।
নির্যাতিতার জন্মদিন উপলক্ষে এ দিন বিভিন্ন কর্মসূচি ছিল শহরতলি থেকে শহরে। ‘তোমায় আমরা ভুলিনি, ভুলব না’ স্লোগান লেখা ব্যানার হাতে স্থানীয় নাগরিক সমাজের সদস্যেরা মৌন মিছিল শুরু করেন ওই তরুণী চিকিৎসকের বাড়ির
সামনে থেকে। অন্য দিকে, ‘জন্মদিনের অঙ্গীকার, বাংলার মেয়ের সুবিচার’ এই দাবিতে জুনিয়র ডক্টর্স ফ্রন্ট এ দিন ওই চিকিৎসকের বাড়ির এলাকায় দুটি ‘অভয়া ক্লিনিক’-এর আয়োজন করে। দু’টি শিবির মিলিয়ে
প্রায় আড়াইশো জন মানুষ চিকিৎসা পরিষেবা নেন। দুই জায়গাতেই সাধারণ মানুষের কাছে গিয়ে পাশে থাকার আবেদন জানান নির্যাতিতার বাবা-মা। তার পরে ফিরে আসেন বাড়িতে।
এই দিন প্রতি বছরই গুড়ের পায়েস রান্না হত। বিগত বছরের মতো বাড়িতে ছিল না আত্মীয়-বন্ধুদের ভিড়। শুধু এসেছিলেন পরিচিত এক সন্ন্যাসী। মায়ের কথায়, ‘‘ঘটনার পরে আমতার আশ্রমের ওই সন্ন্যাসী নিজে থেকেই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। তিনি এসে গীতা পাঠ করলেন। আলমারি থেকে আজ ওর পছন্দের ঘড়িটা বার
করেছিলাম।’’ গত বছর চিকিৎসকের বাবা-মা ঠিক করেন, মেয়েকে উপহারে ঘড়ি দেবেন। সেই মতো দোকানে গিয়ে ভিডিয়ো কল করে মেয়েকে দেখিয়েছিলেন ঘড়িটা। তা দেখে খুব আনন্দ হয়েছিল মেয়ের। কথাগুলি বলতে বলতে বার বার ঝাপসা হচ্ছিল মায়ের চোখ।
নিজেকে সামলে জানালেন, ডাক্তারি পাশ করার পর থেকেই জন্মদিনের দিন শুধু পায়েস বানানো ছাড়া অন্য রান্না মাকে
করতে দিতেন না। বাইরে থেকে খাবার আনাতেন। স্মৃতি উস্কে মা বললেন, ‘‘মেয়ে বলত, ‘মা আজ তোমার ছুটি’। আজ, মনে হাজার কষ্ট হলেও শক্ত থাকছি শুধু ন্যায় বিচারের অপেক্ষায়।’’ এ দিন দু’টি স্বাস্থ্য শিবিরে আসা লোকজনকে একটি করে চারা দেওয়া হয়। তার মধ্যে ছিল জবার চারাও।
সাদা বাড়িটার ছাদে সাজানো টবের গাছে এবং কমলা রঙের বোগেনভিলিয়ার চারায় যেন মেয়েকে অনুভব করলেন বাবা-মা।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)