হাতে চক ধরিয়ে দিয়ে বারবার শিক্ষিকা নির্দেশ দিচ্ছেন ব্ল্যাকবোর্ডে অঙ্ক কষার জন্য। দ্বিতীয় শ্রেণির ছোট্ট সৌমিতা কিছুতেই পারছে না। শিক্ষিকা ধৈর্য হারাচ্ছেন। বলছেন, ‘‘বড্ড অবাধ্য মেয়ে তুমি। এত বার ক্লাসে এই অঙ্ক বোঝানোর পরেও তুমি কেন করছো না? অঙ্ক না করলে বেরিয়ে যাও।’’ শিক্ষিকার বকুনি শুনেও নড়ল না সৌমিতা। শিক্ষিকার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে চক হাতে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল ক্লাসরুমে।
চতুর্থ শ্রেণির সপ্তক আবার একটু বকুনিতেই কান্না জুড়ে দেয়। স্কুলে বন্ধুর পেনসিল পছন্দ। বন্ধু কিছুতেই দেবে না। এত কান্না জুড়ে দিল যে বন্ধুর মা বললেন, ‘‘তুই নিয়ে যা।’’ শিক্ষিকা পরে জানতে চাইলে সপ্তক বলে, ‘‘আমি কাঁদলেই যা চাই পেয়ে যাই। বাবা-মায়ের থেকেও তো এ ভাবেই পছন্দের জিনিসটা পাই।’’
শিশুদের এই বায়না কিংবা কথা না শোনার প্রবণতা দেখে, অনেক অভিভাবকই বকাবকি করেন। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, এমন ব্যবহার দেখা গেলেই সেই শিশুকে বকাবকি নয়, তার বিশেষ যত্ন প্রয়োজন। কারণ, বকুনিতে হিতে বিপরীত হতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, এই শিশুরা স্নায়ুর জটিল রোগ ‘সেনসরি প্রোসেসিং ডিসঅর্ডার’-এ আক্রান্ত হয়। আচরণে অস্বাভাবিকতা ফুটে ওঠে।
জনপ্রিয় হিন্দি ছবি ‘তারে জমিন পর’-এর ছোট্ট ঈশানের কথাই মনে করা যাক। তারও ব্যবহারে ছিল নানা ত্রুটি। যা নিকুম্ভ স্যারের যত্নে ঠিক হয়ে ওঠে। চিকিৎসকেরা পরামর্শ দিচ্ছেন, আশপাশের ছোট্ট ‘ঈশানদের’ চিনে নিক ‘নিকুম্ভ’ স্যারেরা। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, ব্যবহারে অসঙ্গতি অনেক সময়েই পরিবারের কারও চোখে পড়ে না। যা সহজেই বোঝা যায় স্কুলে।
পাশাপাশি চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, সমস্যা চিহ্নিত করতে পারলে কিছু থেরাপির মাধ্যমে এই সব শিশুদের স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দেওয়া যাবে। যত তাড়াতাড়ি তাদের সমস্যাকে চিহ্নিত করা যাবে, ততই সহজ হবে সমাধান। তাই শিক্ষক-শিক্ষিকার এ ব্যাপারে সচেতন ও প্রশিক্ষণ পাওয়া আবশ্যক।
‘সেনসরি প্রোসেসিং ডিজঅর্ডার’-এ আক্রান্ত শিশুদের জীবনকে সহজ করে তুলতে এগিয়ে এসেছে একটি বেসরকারি সংস্থা। যারা বাড়ি ও ক্লিনিকে নানা থেরাপির মাধ্যমে আচরণের ত্রুটিকে ঠিক করে দেয়। এই রোগে আক্রান্ত শিশুদের শরীরের বিভিন্ন স্নায়ু ও পেশির থেরাপি এবং মানসিক ভাবে সুস্থ করার জন্য থেরাপির ব্যবস্থাও করেছে এই সংস্থা।
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, হাত, পা, চোখ, কানের সমস্যা দ্রুতই বোঝা যায়। কিন্তু আচরণে সমস্যা অনেক ক্ষেত্রেই প্রাথমিক ভাবে ধরা পড়ে না। যা পরবর্তীকালে বড় শারীরিক সমস্যায় পরিণত হয়। যেমন, অনেক শিশুই বালি কিংবা মাটি স্পর্শ করতে চায় না। প্রাকৃতিক স্পর্শ না পেলে সেই শিশু পরবর্তীকালে মানুষের স্পর্শও পছন্দ করে না। তবে চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, শুরু থেকেই আক্রান্ত শিশুদের স্নায়ু ও মস্তিষ্কের প্রয়োজনীয় থেরাপি করালে সমস্যা খুব বেশি বাড়বে না।
এই সংস্থার অধিকর্তা চিকিৎসক সোমা ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘শিশুদের সুস্থ করার জন্য সমস্যাটা চিহ্নিত করা জরুরি। সে ক্ষেত্রে স্কুলগুলির ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ।’’ শিশুদের সমস্যা দূর করতে শহরের বিভিন্ন স্কুলও এগিয়ে আসছে বলেই জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। বিভিন্ন আলোচনাচক্র ও সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে চিকিৎসকেদের সঙ্গে নানা বিদ্যালয়ও এগিয়ে আসছেন।
সম্প্রতি এমনই একটি আলোচনাচক্র বসেছিল মর্ডান হাই স্কুল ফর গার্লসে। যেখানে চিকিৎসক, চিকিৎসা পরিষেবা প্রদানকারী বেসরকারি সংস্থা ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন শহরের বিভিন্ন স্কুলের ৮০ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা।
স্কুল কর্তৃপক্ষ জানান, তাঁরা চান শিশুরা সব বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যাক। যারা এগিয়ে যেতে পারছে না, তাদের হাত ধরে সাহায্য করতে প্রস্তুত থাকতে চান নিজেরা। নিউ টাউনের দিল্লি পাবলিক স্কুলের মনোবিদ ইন্দিরা রায় মণ্ডল বলেন, ‘‘আমাদের স্কুলে যে সব শিশুরা আচরণগত সমস্যায় ভুগছে, তাদের যেমন আলাদা ভাবে বিশেষ যত্ন নেওয়া হয়, তেমনই আবার অন্য শিশুদের সঙ্গে বসেই ক্লাসও করে তারা। যাতে ওদের সম্পূর্ণ বিকাশ ঘটে।’’
লোরেটো ডে স্কুলের শিক্ষিকা সেমন্তী মিত্র বলেন, ‘‘অনেক সময়েই আমরা বাচ্চাদের সমস্যা বুঝতে পারি না। এই ধরনের আলোচনা যত বেশি হবে, তত ভাল ভাবে শিশুদের সমস্যা বুঝতে পারব আমরা।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy