Advertisement
E-Paper

মণ্ডপ ভাঙল হাতিবাগানে, জলে ডুবে বহু প্যান্ডেল, চার দিনের মধ্যে ক্ষয়ক্ষতি সামলাবেন কী ভাবে? আতান্তরে উদ্যোক্তারা

পুজোর আর চার দিন বাকি। তার মাঝেই সোমবার রাতভর বৃষ্টিতে ভাটা পড়ল শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিতে। বানভাসি শহরের কোথাও ভেঙে পড়েছে মণ্ডপের একাংশ, কোথাও হাঁটুজল জমে গিয়েছে প্যান্ডেলের ভিতরেও। শারদোৎসবের সময় এমন নজিরবিহীন বৃষ্টি এর আগে দেখেনি কলকাতা।

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৪:৫১
কোথাও ভেঙেছে প্যান্ডেল, জল থইথই চারদিক! পুজোর আগে মাথায় হাত উদ্যোক্তাদের।

কোথাও ভেঙেছে প্যান্ডেল, জল থইথই চারদিক! পুজোর আগে মাথায় হাত উদ্যোক্তাদের। — নিজস্ব চিত্র।

আজ দ্বিতীয়া। পুজো শুরু হতে আর মাত্র কয়েক দিন বাকি। এত দিনে শহরের বেশির ভাগ পুজোমণ্ডপেই কাজ প্রায় শেষের দিকে। চলছিল শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। কিন্তু সোমবার রাতভর বৃষ্টিতে গোল বেধেছে। বানভাসি শহরের কোথাও ভেঙে পড়েছে মণ্ডপের একাংশ, কোথাও হাঁটুজল জমে গিয়েছে প্যান্ডেলের ভিতরে। শারদোৎসবের সময় এমন নজিরবিহীন বৃষ্টি এর আগে দেখেনি কলকাতা। মঙ্গলবার সকালেও ঝিরঝিরে বৃষ্টি চলছে। বুধবার থেকে বৃষ্টির দাপট আরও বাড়তে পারে বলে পূর্বাভাস আবহাওয়া দফতরের। এই পরিস্থিতিতে কী ভাবে সময়ে প্যান্ডেলের কাজ শেষ হবে, সে সব ভেবে মাথায় হাত পড়েছে পুজো কমিটির কর্তাদের।

কোন পুজোর কী অবস্থা?

নাজেহাল দশা শহরের বড় বড় পুজোগুলির। সিংহী পার্ক সর্বজনীনের পুজোর এ বার ৮৪তম বর্ষ। বিষয়বস্তু নবচেতনায় অকালবোধন। মঙ্গলবার দুপুরে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী এসে পুজো উদ্বোধন করবেন, এমনটাই কথা ছিল। কিন্তু রাতভর বৃষ্টিতে রাস্তায় কোমর পর্যন্ত জল। জমা জলের তোড়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছে প্যান্ডেলের নীচের অংশের কাজ। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে নতুন করে প্যান্ডেল খুলে বানানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন শিল্পী সুদীপ্ত মাইতি। কাজ শেষ হবে কি না, তা নিয়ে আশঙ্কায় পুজো কমিটি।

একই চিত্র দেখা গেল উল্টোডাঙা সংগ্রামীতে। সেখানে প্যান্ডেলের ভিতরেও হাঁটুসমান জল জমে রয়েছে। পুজো উদ্যোক্তারা জানাচ্ছেন, পার্শ্ববর্তী খাল উপচে গোটা এলাকা জলমগ্ন হয়ে গিয়েছে। দীর্ঘ ক্ষণ ধরে পাম্পিং করা সত্ত্বেও জল নামছে না।

এ বার সল্টলেক ইসি ব্লক রেসিডেন্স অ্যাসোসিয়েশনের পুজো ৪৯তম বর্ষে পা দিয়েছে। এ বছরের থিম নীর, অর্থাৎ জল! এখন কার্যত সেই জলেই ভাসছে গোটা এলাকা। পাম্পিং করে জল বার করার চেষ্টা চলছে। তবে বেলার দিকে উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, আপাতত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। জলও নেমেছে।

চোরবাগান সর্বজনীন পুজো কমিটির কর্তা জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘আমাদের মাঠে জল ঢুকেছে যখন, তার মানে অন্য এলাকাতেও ভাল রকম জল জমবে। তবে আমাদের পুজোর প্রস্তুতি যেহেতু সারা হয়ে গিয়েছে, তাই কোনও ক্ষতি হয়নি। কিন্তু এলাকায় যাতে জমা জলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে কোনও দুর্ঘটনা না ঘটে, সে দিকে আমরা নজর রাখছি। সিইএসসি-র সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে।’’

ত্রিধারা সম্মিলনীর পুজোর কর্মকর্তা তথা রাসবিহারীর বিধায়ক দেবাশিস কুমার জানিয়েছেন, তাঁর পুজো মণ্ডপ এলাকায় জল জমেনি। তবে রাসবিহারীর বিভিন্ন অংশে জল জমে থাকায় তা নিয়ে চিন্তিত তিনি।

বড়িশা ক্লাব পুজো কমিটির সভাপতি সুদীপ পল্লে কলকাতা পুরসভার বরো ১৬-র চেয়ারম্যান। আবার ১২৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলরও তিনিই। সুদীপের কথায়, ‘‘আমাদের বড়িশা ক্লাবের পুজোয় সে ভাবে প্রভাব পড়েনি। কাল মুখ্যমন্ত্রী উদ্বোধনও করে দিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু যে বিস্তীর্ণ এলাকা আমার অধীনে রয়েছে, তার মধ্যে আপাতত ১২৫ এবং ১২৬ নম্বর ওয়ার্ডের অবস্থা বেশ উদ্বেগজনক। এর মধ্যে মূলত ঠাকুরপুকুর, সরশুনা এবং বড়িশার বিস্তীর্ণ অঞ্চল পড়ে। গোটা এলাকায় এত বৃষ্টি হয়েছে যে সবই প্রায় ভেসে যাওয়ার জোগাড়।’’ তবে পুরসভার সঙ্গে কথা বলে কোন পুজোর পরিস্থিতি কেমন, তা খোঁজ নিয়ে দেখছেন সুদীপ। বড়িশা সর্বজনীন, ঠাকুরপুকুর স্টেট ব্যাঙ্ক পার্ক সর্বজনীন, পল্লীমঙ্গল— সমস্ত বড় পুজোর পরিস্থিতির দিকে নজর রয়েছে।

বেহালা আদর্শপল্লীর পুজোর উদ্যোক্তা সায়ন্তন ঘোষ জানাচ্ছেন, তাঁদের পুজোর শেষ মুহূর্তের কাজ বাকি ছিল। এমন সময় ভারী বৃষ্টিতে সেই কাজ ভেস্তে গিয়েছে। সায়ন্তনের কথায়, ‘‘পুজোর ফাইনাল টাচ বাকি ছিল। কিন্তু বৃষ্টির জেরে সেই কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। প্যান্ডেলের সামান্য কিছু অংশ ভেঙেও গিয়েছে। এ দিকে বৃহস্পতিবার পুজোর উদ্বোধন। তাই আপাতত যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে কাজে নামতে হয়েছে।’’

বেহালা দেবদারু ফটকের অতনু ঘোষ বলছেন, ‘‘আমাদের পুজো মাঠে হয়। মাঠে জল জমেনি। প্যান্ডেলের সামনে জল জমেছিল। বৃষ্টির জন্য আমাদের প্যান্ডেলের কাজ সাময়িক বন্ধ রাখা হয়। এখন কাজ ফের শুরু হয়েছে।’’

অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছে বেহালা নূতন দলের পুজো। পুজো কমিটির সম্পাদক দেবব্রত মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, যেখানে প্যান্ডেল হয়, সেখানে জল জমেনি। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের এ বার মার্বেলের ফ্লোর আর গ্লাস ফাইবারের প্যান্ডেল হয়েছে। তাই আমাদের প্যান্ডেল সে ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। সব কিছুই আমরা নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছি। কিন্তু শুনছি আশপাশের এলাকায় বেশ জল জমেছে।’’

সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হাতিবাগান নবীন পল্লীর। পুজোর উদ্যোক্তা শৌভিক ভড় বলছেন, ‘‘বৃষ্টিতে প্যান্ডেল ভেঙে গিয়েছে। যা ক্ষতি হয়েছে তা আর পূরণ করা যাবে না। যে হেতু মঞ্চটা একটু উঁচু করে তৈরি করা হয়েছিল, তাই ঠাকুরটা কোনওমতে বেঁচে গিয়েছে। যদি তা না করা হত, তা হলে প্রতিমাও নষ্ট হয়ে যেত।’’ শৌভিকের আক্ষেপ, শেষ মুহূর্তে প্যান্ডেল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এ বারের পুজোয় আর কোনও ছাপ রাখতে পারবে না হাতিবাগান নবীন পল্লী।

হাতিবাগান সর্বজনীনের শাশ্বত বসু জানিয়েছেন, মণ্ডপের পিছনে জল জমে গিয়েছে। আপাতত তা নিয়ে বেশ চিন্তিত পুজো কমিটির সকলেই। শাশ্বত বললেন, ‘‘এ ছাড়াও আশপাশের তিনটি বড় বড় পুজো, যেমন শিকদার বাগান, হাতিবাগান নবীন পল্লী এবং নলিন সরকার স্ট্রিট— সব জায়গায় জল জমে আছে। কী যে হবে, বুঝতে পারছি না।’’

এ বার ৬৫তম বর্ষে পা দিয়েছে শ্যামবাজার পল্লি সঙ্ঘের পুজো। কমিটির তরফ থেকে সুব্রত ভট্টাচার্য জানাচ্ছেন, আর একটু বৃষ্টি হলেই প্যান্ডেলে জল ঢুকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। রাস্তা আর প্যান্ডেলে ঢোকার মুখে প্রায় সমান সমান জল। অথচ সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েই প্যান্ডেল তৈরি করা হয়েছিল। ফলে এখন প্যান্ডেল সরিয়ে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়! চিন্তায় ঘুম উড়েছে উদ্যোক্তাদের।

বেলেঘাটা পল্লি উন্নয়ন সমিতির পুজো কমিটির প্রধান রাজু সেন জানাচ্ছেন, জল জমেছে তাঁদের প্যান্ডেলেও। বুস্টার পাম্প এনে এবং ড্রেন পরিষ্কার করে দ্রুত জল সরানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।

একই চিত্র বেলেঘাটার গান্ধী মাঠ ফ্রেন্ডস সার্কেলে। বেলেঘাটা মেন রোডে প্রায় এক হাঁটু জল। পুরসভার কর্মীদের সঙ্গে ড্রেন পরিষ্কার করে জল নামানোর কাজে হাত দিয়েছেন উদ্যোক্তারা। বেলার দিকে জল খানিক নেমেছে। আপাতত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে।

দমদম নাগেরবাজার ক্ষুদিরাম কলোনির পুজো এ বছর ৭৬তম বর্ষে পা দিচ্ছে। ডেঙ্গির বাড়বাড়ন্তের আশঙ্কা নিয়ে সতর্ক দক্ষিণ দমদম পুরসভা এলাকার পুজোগুলির উদ্যোক্তারা। আগাম প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। পুজো কমিটির তরফে প্রণব দে জানালেন, জল না জমলেও মাঠে বাঁশের কাজের জন্য বেশ কিছু গর্ত তৈরি হয়েছিল। সেখানে জল জমছে। সেই জমা জলে যাতে মশার লার্ভা না জন্মায়, সে জন্য পুজো কমিটির তরফে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছে বেলগাছিয়া সাধারণ দুর্গোৎসবের পুজো। পুজো কমিটির তরফ থেকে সৌমিক সাহা জানালেন, কোনও বছর উঁচু প্ল্যাটফর্ম বানিয়ে পুজো হয় না। কিন্তু এ বছর বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকায় আগে থেকেই উঁচু প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয়েছিল। একই ভাবে বেঁচে গিয়েছে দক্ষিণপাড়া যুব পরিষদের পুজো। আগে থেকেই প্লাইয়ের উপর তৈরি করা হয়েছে মণ্ডপ।

তবে পূর্বাচল উদয়ন সংঘের পুজোর অবস্থা বেশ খারাপ। উদয়ন সংঘের মণ্ডপসজ্জায় এ বার বেশির ভাগই ছিল রং-তুলির কাজ। কিন্তু মণ্ডপ খোলা থাকায় বাইরের অংশের রং-তুলির কাজ অনেকটাই ধুয়ে গিয়েছে। পুজোর আগে কী ভাবে কাজ শেষ হবে, আশঙ্কায় শিল্পী সোমনাথ মুখোপাধ্যায়।

প্যান্ডেলের ভিতরে জল ঢুকে গিয়েছে যাদবপুর অ্যাথলেটিক ক্লাবে। প্রতিমাও জলের তলায়। এলাকা জুড়ে বিদ্যুৎ নেই। দমকল কর্মীরা বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছেন। কী ভাবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হবে, তা নিয়ে রীতিমতো চিন্তায় পুজোকর্তারা।

খিদিরপুর ২৫ পল্লির পুজো কমিটির প্রচারসচিব কালী সাহা বলছেন, ‘‘শুধু ২৫ পল্লিই নয়, আমাদের এখানে আরও যে পুজোগুলি হয়, যেমন ৭৪ পল্লি, সিমলা ব্যায়াম সমিতি—এই সব চত্বরে জল জমেনি। আমাদের প্যান্ডেলও অক্ষত রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমরা ভাগ্যবান যে বৃষ্টির মধ্যেও সে ভাবে বিপর্যয় হয়নি প্যান্ডেলে।’’

মঙ্গলবার শহরের কয়েকটি পুজোর উদ্বোধন করতে যাওয়ার কথা ছিল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তা বাতিল করা হয়েছে। পুজো উদ্বোধন কর্মসূচি বাতিল করেছেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীও। মুখ্যমন্ত্রীর পাড়ার পুজো কালীঘাট মিলন সঙ্ঘের তরফে সত্যজিৎ দে জানিয়েছেন, তাঁদের এলাকায় জল জমেনি। ফলে মণ্ডপচত্বর ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও সব রকমের প্রস্তুতি নিয়ে রাখছেন তাঁরা।

এখনও চলবে দুর্যোগ?

কলকাতা পুরসভার কন্ট্রোল রুম সূত্রে খবর, সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার ভোর পর্যন্ত শহরে প্রায় ৩৩২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। বেলার আগে উত্তর কলকাতার কয়েকটি জায়গায় জল নেমে গেলেও বিকে পাল, বিটি রোড, কলেজ স্ট্রিট, সিআর অ্যাভিনিউ, জেএম অ্যাভিনিউয়ের মতো রাস্তায় এখনও জল দাঁড়িয়ে রয়েছে। কলকাতা পুরসভার সংযুক্ত এলাকা বেহালা, বড়িশা, ঠাকুরপুকুর, জোকা, মেটিয়াবুরুজ এবং গার্ডেনরিচের বেশ কিছু এলাকাও জলমগ্ন। এমতাবস্থায় ফের ভারী বৃষ্টি হলে পরিস্থিতি কী হবে, তা নিয়ে গভীর উদ্বেগে রয়েছে পুরসভা। কলকাতার পুরসভার মেয়র পরিষদ (নিকাশি) তারক সিংহ বলেন, ‘‘আমাদের নিকাশি বিভাগ কাজ শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু যদি আবার বৃষ্টি হয়, তা হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। কিন্তু অতিরিক্ত বৃষ্টি না হলেও শহরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা সময় লাগবে!’’

Heavy Rain Durga Puja puja pandals rainfall waterlogging
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy