একটি শহরের সঙ্গে কোনও ভিনদেশিকে পরিচয় করানোর সহজ পথ হল সেই শহরের স্থাপত্যের সঙ্গে তাঁর আলাপ করানো। ইন্ডিয়া গেট বা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ছবি দেখলেই মগজে ও মনে যেমন ভেসে ওঠে দিল্লি বা কলকাতার নাম। কিন্তু ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের বদলে কোনও দেশি স্থাপত্যের খোঁজ করলে? দিল্লির আছে যন্তরমন্তর, লালকেল্লা বা কুতুব মিনার। তবে কলকাতার ক্ষেত্রে সম্ভবত উত্তরটা হবে কালীঘাট মন্দির। আঠারো শতকে বালথাজ়ার সলভিন্স-এর ছবি থেকে উনিশ শতকে উইলিয়াম রসলার-এর উদ্যোগে লিথোগ্রাফে ছাপা পিকচার পোস্টকার্ড, অথবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন চিত্রগ্রাহকের ক্যামেরা— বহুবার কলকাতাকে বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়েছে বাংলা রীতির, প্রাচীন এই আটচালা মন্দিরটি।
কলকাতা ও সন্নিহিত অঞ্চলের প্রাচীনত্ব নিয়ে গবেষণার জন্য উপাদানের খোঁজে অতুলকৃষ্ণ রায় থেকে প্রাণকৃষ্ণ দত্ত পর্যন্ত আঞ্চলিক ইতিহাসবিদদের বার বার ফিরে আসতে হয়েছে কালীঘাট ও কালীক্ষেত্রের ইতিহাস, ভূগোল এবং লোকগাথার কাছে। এই কালীক্ষেত্রের ব্যাপ্তি সম্পর্কে নিগমকল্পের পীঠমালা তন্ত্রে বলা হচ্ছে যে, দক্ষিণেশ্বর থেকে বহুলা (বেহালা) পর্যন্ত বিস্তৃত দুই যোজন (ষোলো মাইল) ব্যাপী, ধনুকের মতো আকৃতির স্থানটি কালীক্ষেত্র নামে পরিচিত। এর মাঝখানে কালিকা দেবীকে রেখে তিন কোণে তিনটি মন্দিরে ত্রিগুণাত্মক ব্রহ্মা বিষ্ণু ও মহেশ্বরের অধিষ্ঠান। কালের গতিতে ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর মন্দির বিলুপ্ত হলেও, নকুলেশ্বর ভৈরব হিসাবে রয়ে গেছেন মহেশ্বর। আর সেই কালিকা দেবীই প্রতিষ্ঠিতা কালীঘাট মন্দিরে। দক্ষিণবঙ্গের পথ দিয়ে বণিকেরা জলপথে নানা জায়গায় বাণিজ্যে যাওয়ার সময়, অথবা তীর্থযাত্রীরা গঙ্গাসাগর যাওয়ার পথে এই তিন মন্দির এবং কালীঘাটে প্রণাম করে যেতেন। সাবর্ণ রায়চৌধুরীরা জমিদারি পাওয়ার পর হালিশহর থেকে বড়িশা পর্যন্ত একটি রাস্তা তৈরি করেন। জঙ্গলের হিংস্র পশু ও চোর-ডাকাতের উপদ্রব থাকলেও, কালীঘাট যাত্রা সেই কারণে খানিকটা সুগম হয়। সেই তীর্থপথের একটি অংশ নিয়েই গড়ে ওঠে সাবেক চিৎপুর রোড বা আজকের রবীন্দ্র সরণি, যে রাস্তাকে ঔপনিবেশিক কলকাতার ‘নেটিভ টাউন’-এর জীবনরেখা বলা যায়। তাই সতীপীঠের মাহাত্ম্য ছাড়াও শহরের সামগ্রিক বিবর্তনের ইতিহাসে কালীঘাটের গুরুত্ব স্বীকার করতেই হয়।
কালের গতিতে মন্দির সংলগ্ন আদিগঙ্গায় জোয়ার-ভাটার খেলা আর মালবাহী নৌকার আনাগোনা হারিয়ে গেলেও, এলাকার প্রাচীন মিষ্টান্ন প্রতিষ্ঠান বা পটুয়াপাড়ার ঐতিহ্যবাহী গাজন উদ্যাপন আজও আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় দু’শো বছর আগের কলকাতায়। মাঝে প্রাচীন মন্দিরটি সংস্কার করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। সময়ের সেই দাবি মেনে সংস্কারের সঙ্গে রূপটান পড়েছে মন্দিরের গায়ে। এর মধ্যেই প্রচারমাধ্যম সূত্রে জানা গিয়েছিল, আগামী পয়লা বৈশাখ আধুনিক রূপে সেজে উঠবে কালীঘাট মন্দির। এই উপলক্ষে ও নববর্ষের আবহে আরও এক বার কলকাতার এই ‘আইকন’-এর ইতিহাস-আলাপটুকু ঝালিয়ে নিতে পারলে মন্দ কী! ছবিতে ২০০০ সালের নববর্ষে কালীঘাট মন্দির প্রাঙ্গণ।
মায়াডোরে

লীলা মজুমদারের (ছবি) প্রথম বই বেরোয় পঁচাশি বছর আগে, ১৯৪০-এ। বদ্যিনাথের বড়ি। লেখিকা নিজেই অলঙ্করণ করেছিলেন বইয়ের। বইটি পুনঃপ্রকাশিত হল সম্প্রতি, বিচিত্রপত্র গ্রন্থন বিভাগ থেকে। প্রকাশিত হল তাঁর কল্পবিজ্ঞান সমগ্র-ও। নন্দন ৩’এ সম্প্রতি হয়ে গেল আন্তরিক এক অনুষ্ঠান, বইপ্রকাশের সঙ্গে তাঁর নামাঙ্কিত চতুর্থ বার্ষিকী স্মারক বক্তৃতারও আয়োজন করেছিল প্রকাশনা সংস্থাটি— সঙ্গী বিচিত্রপত্র, কিংবদন্তী ও সন্দেশ পত্রিকা। বক্তা ছিলেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়। শিশু-কিশোর পাঠক-পাঠিকার প্রিয় গদ্যকার লীলা মজুমদার যে মায়াডোরে বেঁধে রাখতেন তাদের, অন্তরালে লুকোনো থাকত তাঁর যে লিখনশৈলীর জাদু, তারই উদ্ঘাটন হল। প্রসাদরঞ্জন রায় সন্দীপ রায় ও মীরা ভট্টাচার্যের উপস্থিতিতে বেরোল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জীবনানন্দ গ্রন্থটিও, প্রচ্ছদে সত্যজিৎ-কৃত প্রতিকৃতি। সত্যজিতের তথ্যচিত্র সুকুমার রায়-এর রেস্টোর্ড ভার্সন দেখতে পাওয়া ছিল বড় প্রাপ্তি।
জনতার সাহিত্য
ক্ষমতার দিকে অস্বস্তিকর প্রশ্ন ছুড়ে দেয় অনেক কলম, সব দেশে সব কালেই তাদের থামাতে নড়েচড়ে বসে ক্ষমতাতন্ত্র। তবু হয়ে চলে প্রতিরোধের শিখা অনির্বাণ রাখার প্রয়াস। গত কয়েক বছর ধরে তেমনই এক ব্যতিক্রমী আয়োজনের সাক্ষী থাকছে শহর। ‘কলকাতা পিপল’স লিটারারি ফেস্টিভ্যাল’ এ বছর সপ্তম বর্ষে— সাহিত্যের আঙিনায় নারী, দলিত, সংখ্যালঘু, শ্রমজীবী ও প্রান্তিক মানুষের জীবনকথা। সংখ্যাগুরুবাদের প্রসারে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের মুখে নানা আঙ্গিক থেকে তার প্রতিরোধ নিয়ে আলোচনায় অংশ নেবেন দেশময় এই লড়াইয়ে থাকা প্রগতিশীল সাহিত্যকর্মীরা। আগামী কাল রবিবার ১৩ এপ্রিল রাসবিহারীর মুক্তাঙ্গনে অনুষ্ঠান, দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা।
নাট্য-আয়োজন
চৈত্রশেষে বঙ্গরঙ্গমঞ্চের সাড়া-জাগানো সব নাটক সদ্য শুরু হয়েছে অ্যাকাডেমি মঞ্চে, চলবে আগামী ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত। থিয়েটারপ্রেমী বাঙালির কাছে অবশ্যই সুবন্দোবস্ত। উদ্যোক্তা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের স্নেহলালিত ‘মুখোমুখি’ নাট্যদল, ঊনত্রিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে তাদের এই উৎসব। “চার পাশের এই বিপর্যস্ত সময়ে মানুষ যদি একটু বেঁচে থাকার শ্বাস খুঁজে পায়, তাই এ আয়োজন,” নাট্যদলের তরফে বলছিলেন বিলু দত্ত। উদ্বোধনে চপল ভাদুড়ী ও শঙ্কর চক্রবর্তীর সম্মাননার সঙ্গে ‘মনু দত্ত স্মৃতি সম্মান’-এ ভূষিত হলেন সৌতি চক্রবর্তী। গতকাল অভিনীত হল মেফিস্টো, আজ থেকে চন্দনপুরের চোর, টিনের তলোয়ার, পাঞ্চজন্য, মারীচ সংবাদ, নরক গুলজার— অরুণ মুখোপাধ্যায় সুমন মুখোপাধ্যায় সোহিনী সেনগুপ্ত বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায় পৌলমী চট্টোপাধ্যায়ের নির্দেশনায়।
তনু-মন
সেলুলয়েডে তাঁর বিশ্বায়ন-পূর্ব গ্রাম ও শহরের মধ্যবিত্ত জীবনের ছবি, বসন্ত উৎসব, বিজয়া সম্মিলনী, রকের আড্ডা, প্রথম প্রেমের গান আজও বাঙালির প্রিয়। তরুণ মজুমদারের ছবিজীবন নিয়ে লেখালিখি কম হয়নি, সেই ধারায় নতুন সংযোজন শহরের নতুন পত্রিকা সিনেমানবিক-এর বিশেষ সংখ্যা: ‘তনু মন প্রাণ’ (সম্পা: স্বস্তিক সরকার)। ওঁর ছবিতে নারীচরিত্র, সঙ্গীত, প্রেম, আটপৌরে জীবন ও মানবিক দৃষ্টিকোণ নিয়ে একগুচ্ছ লেখা, সঙ্গে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অরন্ধনের নিমন্ত্রণ’ ছোটগল্প, নিমন্ত্রণ যা থেকে। তরুণবাবুর সাক্ষাৎকারের পুনর্মুদ্রণ, আর একটি সাক্ষাৎকারে সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় ধরেছেন ওঁর সিনে-দর্শন: “তনুবাবু তাঁর ছবির মাধ্যমে মানুষের মধ্যে বিশ্বাস ও আস্থা প্রদান করার চেষ্টা করে গেছেন।”
দরদি
পাঠভবনের সবার প্রিয় বাংলা শিক্ষক গৌতম ভট্টাচাৰ্য শান্তিনিকেতনে আসেন ১৯৭৭-এ। সাইকেল, সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর ঝোলাব্যাগ নিয়ে ওঁর আশ্রমময় বিচরণ, ছাত্রছাত্রীদের অমূল্য পাঠ বিতরণ ছিল চেনা দৃশ্য। জন্ম কলকাতায় ১৯৪৮-এ, মৌলানা আজাদ কলেজে অর্থনীতি ও পরে যাদবপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের পাঠ। ফাদার আঁতোয়ান নরেশ গুহ বিষ্ণু দে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত শঙ্খ ঘোষের নিবিড় সঙ্গ ও স্নেহধন্য, পরে শান্তিনিকেতনে শিক্ষকতায় সঁপেছেন নিজেকে। কর্মী মণ্ডলী, গবেষণা বিভাগ, গ্রন্থন বিভাগে জরুরি দায়িত্ব সামলেছেন, পরিচালনা করেছেন বিশ্বভারতীর নানা অনুষ্ঠান। ছাত্রাবস্থা থেকেই নাটকের প্রতি টান ও নাটক-অনুবাদ, লিখেছেন ও সম্পাদনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বহু গ্রন্থ, তাঁর সম্পাদিত কালানুক্রমিক রবীন্দ্ররচনাবলী অমূল্য ধন। ছাত্রদরদি মানুষটি প্রয়াত হলেন গত ৩ এপ্রিল।
না-দেখা

প্রকৃত শিল্পীর কাজের ছোট-বড় হয় না। প্রমাণ সাইজ়ের ছবির সমান বা বেশি শৈল্পিক অভিঘাতও সৃষ্টি করতেই পারে তাঁর খেয়ালখুশির রোজকার আঁকিবুঁকি, স্কেচ, ডুডল। এ জিনিস বোঝা যায় শানু লাহিড়ীর মতো শিল্পীর কাজ দেখলে— তাঁর জীবন ও মনের প্রাত্যহিকী ও পরিক্রমা দুই-ই ফুটে ওঠে সে সবে, রং ও রেখার মিতব্যবহার বাধা হয় না কোনও। নবীনা গুপ্তের কিউরেশনে এ বার শিল্পীর এমন কিছু কাজ— এ যাবৎ যা প্রদর্শিত হয়নি— দেখা যাবে ‘অ্যাননিমাস?’ শিরোনামের প্রদর্শনীতে, শেক্সপিয়র সরণির গ্যালারি ৮৮-তে। থাকবে ওঁর সেই চিত্রকৃতিও, যেগুলি দেখামাত্র চেনা যায় আদি অকৃত্রিম শানু লাহিড়ীকে। শুরু হয়েছে ১ এপ্রিল, দেখা যাবে ১৫ মে অবধি: রবিবার বাদে, গ্যালারি খোলা সোমবার দুপুর ২টা-৭টা, মঙ্গল থেকে শনি সকাল ১১টা-৭টা। ছবিতে শানু লাহিড়ীর আঁকা রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের বিচিত্র চিত্র-মানচিত্র।
নান্দনিক

পশ্চিমবঙ্গ চলচ্চিত্র কেন্দ্র তথা কলকাতাবাসীর প্রিয় ‘নন্দন’-এর চল্লিশ বছর হয়ে গেল দেখতে দেখতে। কম সময় নয়, চারটি দশক জুড়ে কলকাতা চলচ্চিত্রচর্চা, প্রদর্শন ও নানা ফিল্মোৎসবের স্মৃতিচিত্র ধরে রেখেছে সে। আবার এই শহরেরই ফিল্মপ্রেমী কেউ কেউ ধরে রেখেছেন নন্দনের পথ চলার টুকরো বহু অভিজ্ঞান: নন্দনের প্রথম দিকের তিন, পাঁচ ও দশ টাকার টিকিট (ছবি), নানা উৎসব ও অনুষ্ঠানের কার্ড, প্রকাশিত বুলেটিন ইত্যাদি। এমনই এক জন হলেন প্রান্তিক সান্যাল— প্রবীণ মানুষটির সংগ্রহে আছে এই সবই, এবং নন্দন উদ্বোধনের আমন্ত্রণপত্র, পুস্তিকা, উদ্বোধনের সময় প্রকাশিত ছবির তালিকা, ছবি দেখার প্রবেশপত্র, নানা ধরনের লেখা, ফিল্ম কোর্স সংক্রান্ত নথিও। ১১ থেকে ২০ এপ্রিল, সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা, হাজরা মোড়ের কাছে ৫১এ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোড ঠিকানায় এক ঘরোয়া প্রদর্শনীতে দেখার সুযোগ থাকছে এই সবই।
‘হতাশের দলে’?
দ্বিতীয় বছরে পা দিল বাংলা সংস্কৃতির উৎসব ‘কেসিসি বৈঠকখানা’। ই এম বাইপাসের ধারে আনন্দপুরে কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েভিটি (কেসিসি) আয়োজিত এই সাহিত্যের আড্ডায় একটা মূলসূত্র বা ‘থিম’ থাকে, এ বারে তা হল: হেরো। পরাজিতদের প্রতি আমাদের বিশেষ আকর্ষণ আছে, জয়ী অর্জুনের চেয়ে নিয়তি-পীড়িত কর্ণের দিকে আমাদের হৃদয়ের ঝোঁক বেশি। সফল প্রেমিকরা যত হাসি হাসুক, ব্যর্থ দেবদাসের সিংহাসন অনেক উঁচুতে। চ্যাপলিনের ভবঘুরে থেকে গ্রিক ট্র্যাজেডির নায়ক-নায়িকা অবধি এই অশ্রুর মানচিত্র জ্বলজ্বল করছে। নিজেদেরও হেরো ভাবতেই আমরা ভালবাসি, আত্মমায়ায় চোখ ভিজে যায়। ‘হেরো’ নিয়ে ১১ থেকে ১৩ এপ্রিল এই তিন দিন কেসিসি-তে চলবে বক্তৃতা, আলোচনা, বিতর্ক, চিঠি-পাঠ, গান, কবিতাপাঠ— অনেক কিছু। আশা, প্রয়াসটি পরাজিত হবে না!