তদন্তে ফরেন্সিক দল। বৃহস্পতিবার বাগুইআটিতে। —নিজস্ব চিত্র।
আঘাতটা এসেছিল কিশোরী-বেলাতেই। গ্রামের বাড়ি থেকে শহরের যৌন পল্লিতে পাচার করে দেওয়া হয় মেয়েটিকে। সেখান থেকে মুম্বই পাড়ি। আলোয় আলোয় যাওয়া নয়। অন্ধকার থেকে যাত্রা অদ্ভুত অন্ধকারে। এবং সেই তিমির-সফরের অবসান হত্যাকারীর হাতে। বাগুইআটির তরুণী সুভদ্রা হালদারের হত্যাকাণ্ডের তদন্তে নেমে এমনই তথ্য পেয়েছে পুলিশ।
ওই তথ্যের ভিত্তিতে তদন্তকারীদের সন্দেহ, যৌন পল্লিতে বিক্রি হওয়ার পর থেকেই ক্রমশ অপরাধজগতের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন সুভদ্রা। এই খুনের পিছনে তাই অপরাধজগতের যুক্ত থাকার কথাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না পুলিশকর্তারা। তদন্তকারীদের একটি সূত্রের খবর, এই খুনের সঙ্গে ব্ল্যাকমেলিং চক্রেরও যোগাযোগ থাকতে পারে। তবে এ ব্যাপারে এখনও কোনও নিশ্চিত প্রমাণ হাতে আসেনি বলে বৃহস্পতিবার জানান তদন্তকারীরা।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বাগুইআটির অশ্বিনীনগরের একটি ফ্ল্যাটের চানঘর থেকে সুভদ্রার মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। মৃতদেহের পাশে পাওয়া যায় একটি বালিশ। সুরতহালের পরে জানা গিয়েছিল, ওই তরুণীর মাথাতেও আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। প্রাথমিক ভাবে পুলিশের অনুমান, প্রথমে আঘাত করা হয় মাথায়। তার পরে মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্যই বালিশ চাপা দিয়ে শ্বাস রোধ করা হয়েছিল। তবে ওই তরুণীর মৃতদেহে পচন ধরে গিয়েছিল। তাই খুনটা যে-ভাবেই হোক, তার আগে কেউ তাঁকে ধর্ষণ করেছিল কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয় তদন্তকারীদের কাছে। তবে এই ঘটনায় আততায়ীর সংখ্যা একাধিক বলেই মনে করছে পুলিশ।
বিধাননগর পুলিশের গোয়েন্দা-প্রধান কঙ্করপ্রসাদ বারুই জানান, ফরেন্সিক দল এ দিন ওই ফ্ল্যাটে গিয়েছিল। চানঘরের ভিতর থেকে রক্তমাখা কম্বল, বালিশ, চাদর উদ্ধার করা হয়েছে। ফরেন্সিক দলের তল্লাশির পরে তদন্তকারীদের বক্তব্য, হত্যাকাণ্ডটা চানঘরে ঘটেনি। সুভদ্রাকে খুন করার পরে চানঘরে টেনে নিয়ে যাওয়ার চিহ্ন মিলেছে। এই সূত্র ধরেই তদন্তকারীদের অভিমত, আততায়ীর সংখ্যা একাধিক হতে পারে। তবে যে-ভাবে বিনা বাধায় ফ্ল্যাটে ঢুকে খুন করা হয়েছে, তাতে তারা সুভদ্রার পরিচিত বলেই প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে।
পুলিশ বলছে, বাগুইআটির ফ্ল্যাটটি নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। ওই ফ্ল্যাটে বিদ্যুতের সংযোগও নেই। প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, ওই ফ্ল্যাটে আগে সুভদ্রার মা-দিদিও থাকতেন। মাস কয়েক আগে তাঁরা চলে যান। গত কয়েক মাসে একাধিক যুবককে ওই ফ্ল্যাটে যাতায়াত করতে দেখা গিয়েছে বলে তদন্তকারীরা জেনেছেন।
সুভদ্রার কুলতলির গ্রামের বাড়িতেও গিয়েছিল পুলিশ। সেখানে গিয়ে তদন্তকারীরা জানতে পারেন, বছর দশেক আগে কলকাতায় কাজ দেওয়ার নাম করে পাচার করা হয় সুভদ্রাকে। উত্তর কলকাতার এক যৌন পল্লিতে ঠাঁই হয় তাঁর। সেখানেই তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় বিকাশ সিংহ নামে এক যুবকের। তদন্তকারীরা জানান, বিকাশের সঙ্গেই মুম্বই পাড়ি দিয়েছিলেন সুভদ্রা। তখন থেকেই নাম বদলে ফেলে সোনিয়া সিংহ বলে নিজের পরিচয় দিতেন ওই তরুণী।
এ দিন মুম্বই থেকে কলকাতায় এসে পৌঁছন বিকাশ। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তদন্তকারীরা। পুলিশি সূত্রের খবর, মুম্বই থেকে বছর পাঁচেক আগে কলকাতায় এসে বাগুইআটির ফ্ল্যাটটি কেনেন সুভদ্রা। সেটির টাকা সুভদ্রা দিলেও তার মালিকানা বিকাশ ও সুভদ্রা, দু’জনেরই। বছর দুয়েক আগে সুভদ্রার সঙ্গে রাজু সাউ নামে এক যুবকের পরিচয় হয়। ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। বিকাশ তদন্তকারীদের বলেছেন, রাজুর সঙ্গে সুভদ্রার ঘনিষ্ঠতা বাড়ার ফলেই ওই তরুণীর সঙ্গে তাঁর দূরত্ব তৈরি হয়। এক সময় বিকাশ ও সুভদ্রা কলকাতায় একসঙ্গে থাকলেও রাজু আসার পরে তিনি মুম্বই ফিরে যান। তবে সুভদ্রার সঙ্গে তাঁর ফোনে যোগাযোগ ছিল বলে বিকাশ পুলিশকে জানান। সপ্তাহখানেক আগেও তাঁদের মধ্যে কথা হয়েছিল।
সুভদ্রা খুনে বুধবারেই আটক করা হয়েছে রাজুকে। তবে এ দিন তাঁকে ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ। রাজু পুলিশকে জানান, সুভদ্রার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক থাকলেও মাস তিনেক আগে তা ভেঙে গিয়েছিল। তার কারণ হিসেবে জিতান সাহা নামে এক যুবকের সঙ্গে সুভদ্রার সম্পর্কের কথা পুলিশকে জানান তিনি। তদন্তকারীরা বলছেন, জিতানের সঙ্গে সুভদ্রার বিয়ে হয়েছিল। তার পরে ফের নাম বদলে সুভদ্রা হয়েছিলেন সুনীতা সাহা। কিন্তু জিতানকে কোনও দিন বাগুইআটির ফ্ল্যাটে নিয়ে আসেননি ওই তরুণী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy