Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

আকস্মিক দুর্ঘটনা বদলে দিয়েছে ওঁদের ভাইফোঁটা

বেহালা শীলপাড়ার এই মেয়ের শূন্য দৃষ্টি কোথাও মিলে যায় ওই এলাকারই দুই নাবালিকা বছর দশেকের রূপসা আর ছ’বছরের রীতিশার সঙ্গে। দত্ত বাড়ির ওই দুই বালিকা পাড়াতুতো ভাই বছর পাঁচেকের আদি দাসকে এ বারই প্রথম ভাইফোঁটা দেবে ভেবেছিল। আশা পূরণ হয়নি।

স্মরণে: সৌমেনের ছবিতে ফোঁটা দিচ্ছে মামাতো বোন মৌমিতা। মঙ্গলবার, বেহালায়। ছবি: রণজিৎ নন্দী

স্মরণে: সৌমেনের ছবিতে ফোঁটা দিচ্ছে মামাতো বোন মৌমিতা। মঙ্গলবার, বেহালায়। ছবি: রণজিৎ নন্দী

নীলোৎপল বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০১৯ ০২:৪১
Share: Save:

প্রায় প্রতিদিনই শেষ পাতে সন্দেশ লাগত তাঁর। ধান, দূর্বা, চন্দন, প্রদীপের সঙ্গে তাই সন্দেশেরও ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল বাড়িতে। তবে যাঁর জন্য এত আয়োজন, তিনি-ই বাড়িতে নেই। দাদা সশরীরে না থাকুন, তাঁর ছবিতেই ফোঁটা দিয়ে ভ্রাতৃদ্বিতীয়া সারল মাঝেরহাট সেতু বিপর্যয়ে মৃত সৌমেন বাগের মামাতো বোন তেরো বছরের মৌমিতা ঘোষ।

বেহালা শীলপাড়ার এই মেয়ের শূন্য দৃষ্টি কোথাও মিলে যায় ওই এলাকারই দুই নাবালিকা বছর দশেকের রূপসা আর ছ’বছরের রীতিশার সঙ্গে। দত্ত বাড়ির ওই দুই বালিকা পাড়াতুতো ভাই বছর পাঁচেকের আদি দাসকে এ বারই প্রথম ভাইফোঁটা দেবে ভেবেছিল। আশা পূরণ হয়নি। কালীপুজোর রাতে তুবড়ি ফেটে খোলের একাংশ গলায় আটকে মৃত্যু হয় ছোট্ট আদির। মৌমিতা বলে, ‘‘রূপসা আর রীতিশার অবস্থা বুঝি। দাদা নেই, আমিও ভাবতে পারি না। এ বার ওর ছবিতেই ফোঁটা দিয়েছি। আগে এই দিনটায় আমাকে বই নয়তো চকলেট উপহার দিত। উপহার আর পাব না, তবে ছবিতে ফোঁটা প্রতিবারই দেব।’’

হঠাৎই বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে ভ্রাতৃদ্বিতীয়া কাটানো পরিবারের সংখ্যা নেহাত কম নয়। কোনও পরিবারের সদস্যের আকস্মিক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে। কোথাও ভাইয়ের দীর্ঘায়ু কামনা করতে জীবিত নেই এক মাত্র বোনই। মোটরবাইক দুর্ঘটনায় জন্মদিনের দিনই কয়েক মাস আগে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছে তাঁর দেহ। এক পরিবারে আবার তিন দিদিকে রেখেই ঠিক ছ’দিন আগে খুন হয়েছেন বছর পঁয়ত্রিশের ভাই।

দিনটা কী ভাবে কাটল? প্রশ্ন শুনে কথা বেরোয় না ঠাকুরপুকুর মুকুন্দদাস পল্লির বাসিন্দা টুকু মাঝির। প্রতিবেশীরা জানান, ছ’দিন আগেই খুন হওয়া পেশায় রিকশাচালক ভাই গৌতমের ছবি নিয়ে সারা দিন কেটেছে তাঁর। পুলিশ এই ঘটনায় দু’জনকে গ্রেফতার করেছে ঠিকই তবু টুকুদেবী বলেন, ‘‘কার দোষ জানি না। আমার ভাইকে কেন খুন করা হল তা-ও জানি না। শুধু জানি, ছবিটুকু ছাড়া আমার ভাইয়ের আর কিছু নেই।’’ পাশে বসা টুকুদেবীর বছর পঁচাত্তরের বৃদ্ধা মা নমিতা ঘোষ বলে চলেন, ‘‘ছেলেটা মাংস খেতে ভালবাসে। সকাল থেকে কিছু খায়নি। দেখলাম না এক বারও, গেল কোথায়? আজ না ভাইফোঁটা! কেউ ওকে একটু ডেকে দে না।’’

গত ১৪ অগস্ট রাতটাকে ভাইফোঁটার দিনেও ভুলতে পারছেন না মানিকতলার শানু রায়। ওই দিনই তাঁর বোন মনীষার আঠারো বছরের জন্মদিন ছিল। রাতে বন্ধুদের সঙ্গে বেরিয়ে তিনি আর ফেরেননি। শানু বলেন, ‘‘ফোন করে এক জন বলেছিলেন, বাইপাসের উপরে বোন বাইক থেকে পড়ে মারা গিয়েছে। দ্রুত হাসপাতালে চলে আসুন। কথাটা এখনও কানে বাজে। আজ ওই কথাটাই বেশি করে মনে পড়ছে।’’ জানান, প্রতিবার এই দিনে দুপুরে ফোঁটা দেওয়ার পরই দাদার কাছে হাত-খরচের বায়না ধরতেন মনীষা। শানুর আক্ষেপ, ‘‘টাকা চাওয়ার আর কেউ নেই। শুধু একটা ছবি আছে। আজ বাড়িতে থাকতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে।’’

এ দিকে দিদির কষ্ট লাঘব করতে এ বার আর বাড়িতে থাকা হয়নি বনগাঁর ঈশান সরকারের। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি স্কুলে যাওয়ার পথে অটো উল্টে কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালে ঈশানের দিদি বছর বারোর পৃথা সরকারের ডান হাত কাটা যায়। তার পর থেকে বাঁ হাতেই লেখার চেষ্টা করে পৃথা। তাদের পরিবারের রীতি, দাদাকে ফোঁটা দিতে হয় ডান হাতে। ভাইকে বাঁ হাতে। সে দিক থেকে পৃথার সমস্যা ছিল না। তবু যদি মেয়ের মন খারাপ হয়! তাই বাবার সঙ্গে হায়দরাবাদ যাওয়া ঈশানকে ভাইফোঁটার আগে দিদির কাছে ফিরতে দেওয়া হয়নি। আধো গলায় পৃথা বলে, ‘‘আমার কোনও অসুবিধা ছিল না কিন্তু।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bhaifota Fire Cracker
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE