Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
History of Kolkata

গঙ্গায় ঘেরা একটা দ্বীপ ছিল কলকাতা, বাগবাজার ছিল বাঁকবাজার

প্রাচীন কলকাতার বনভূমি ছিল দু’রকম— লবণহ্রদের দিকে সুন্দরী বৃক্ষ, হেতাল জাতীয় গাছ আর পশ্চিম ধারায় ছিল শিমূল গাছের বনভূমি।

আজকের কলকাতা আগে যেমন ছিল। ব্রিটিশ আমলের একদম গোড়ার দিকে।

আজকের কলকাতা আগে যেমন ছিল। ব্রিটিশ আমলের একদম গোড়ার দিকে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ। গ্রাফিক ভাবনা: লেখক।

হরিপদ ভৌমিক
হরিপদ ভৌমিক
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০২১ ১৬:৪৮
Share: Save:

প্রায় সকলেই জানেন সুতানুটি-কলকাতা-গোবিন্দপুর নিয়ে বর্তমান কলকাতার সূচনা হয়েছিল ১৬৯৮ খ্রিস্টাব্দের ১০ নভেম্বর তারিখে। এই দিন ১৩০০ টাকার বিনিময়ে ইংরেজ কোম্পানি যে দলিল সূত্রে খাজনা আদায়ের অধিকার পেয়েছিল সেই দলিলটি লেখা হয়েছিল ফার্সিতে।

কেমন ছিল সেই সময়ের কলকাতা? ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তিন গ্রামের খাজনা স্বত্ব পাওয়ার ৯ বছর পর কলকাতার যে ছবি আমরা পাই, তা আজকের শহরকে দেখে কল্পনাও করা মুশকিল।

ফোর্ট উইলিয়ম (ব্রিটিশদের তৈরি পুরনো কেল্লা) তখন এখানে ইংরেজ বণিকদের কেন্দ্র। ভিতরে ভিতরে বাণিজ্যিক ক্ষমতাকে শাসন ক্ষমতায় বদলানোর পরিকল্পনা চলছে। ইজারা নেওয়া তিন গ্রামের জরিপ শুরু হচ্ছে। সেই জমি জরিপের হিসেব পাঠানো হচ্ছে ইংল্যান্ডে।

ফার্সিতে লেখা সুতানুটি-কলকাতা-গোবিন্দপুর বিক্রির সেই দলিল। দলিলটি রাখা আছে লন্ডনের মহাফেজখানায়।

ফার্সিতে লেখা সুতানুটি-কলকাতা-গোবিন্দপুর বিক্রির সেই দলিল। দলিলটি রাখা আছে লন্ডনের মহাফেজখানায়।

১৭০৭ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে যে জমি জরিপের হিসাব ফোর্ট উইলিয়ম থেকে করা হয়েছিল তাতে দেখা যাচ্ছে— সুতানুটি, গোবিন্দপুর এবং কলকাতায় তখন যে পরিমাণ জঙ্গল আর চাষজমি, তার ধারেকাছে নেই বসত জমির পরিমাণ। ওই গ্রাম তিনটির অবস্থা কেমন ছিল তা একবার দেখে নেওয়া যেতে পারে। কোম্পানির সেরেস্তায় যে ইংরেজি বানান লেখা হয়েছিল এখানে সেটি রাখা হল ওই সময়টিকে ধরার জন্য:

সুতানুটিতে দেখা যাচ্ছে— বাড়িঘরের জমির পরিমাণ যেখানে ১৩৪ বিঘার মতো, সেখানে ধানজমি ৫১৫ বিঘা আর জঙ্গল ছিল ৪৮৭ বিঘা। টাউন কলকাতার ছবিটাও একই রকম। বাড়িঘরের জমির পরিমাণ ছিল ২৪৮ বিঘার মতো। সেখানে জঙ্গল ৩৬৪ বিঘার কাছাকাছি। ধানজমি প্রায় ৪৮৫ বিঘার মতো।

গোবিন্দপুরের ছবিটাও তখন একই রকম। ধানজমির পরিমাণ বসতজমির ৯ গুণ।

সেই সময় সাহেবপাড়া বা হোয়াইট টাউন এবং দেশিপাড়া অর্থাৎ ব্ল্যাক টাউন নামে আলাদা আলাদা পরিচিতি ছিল। আমরা আপাতত দেশিপাড়ার কথাই আপনাদের শোনাব। শুরুরও একটা শুরু আছে। কলকাতার প্রাচীন পরিচয় ‘কালীক্ষেত্র’ নামে। এটি একটি ধনুকের আকারের দ্বীপ ছিল।

নিগমকল্পের পীঠমালা তন্ত্রমতে:

দক্ষিণেশ্বরমারভ্য যাবচ্চ বহুলাপুরী।

ধনুকাকার ক্ষেত্রঞ্চ যোজনদ্বয় সংখ্যাকং।।

অর্থাৎ, দক্ষিণেশ্বর থেকে বহুলাপুরী পর্যন্ত ধনুকাকার দুই যোজন জায়গা জুড়ে কালীক্ষেত্র।

কলকাতা যে একসময় ধনুকের মতো দেখতে একটি দ্বীপ ছিল এ কথা কেউ বিশ্বাস করতে চাইবেন না। তন্ত্রের কথা বা প্রাচীন অন্য কোনও তথ্য দিতে গেলেই পাথুরে প্রমাণ চাই। প্রমাণ ছাড়া কোনও কথা হবে না। সেই কারণে প্রমাণটা আগে দিয়ে দিচ্ছি:

২০১২ সালে কলকাতা পুরসভা ব্রিটিশ আমলের খাসমহল জমির যে তথ্য প্রকাশ করেছিল, সেই অনুযায়ী নগরায়ন পর্বের একদম গোড়ার দিকের কলকাতার মানচিত্র এটি। গ্রাফিকটি দ্য টেলিগ্রাফ (কলকাতা)-র ১১ জুলাই ২০১২ সংস্করণ থেকে নেওয়া।

২০১২ সালে কলকাতা পুরসভা ব্রিটিশ আমলের খাসমহল জমির যে তথ্য প্রকাশ করেছিল, সেই অনুযায়ী নগরায়ন পর্বের একদম গোড়ার দিকের কলকাতার মানচিত্র এটি। গ্রাফিকটি দ্য টেলিগ্রাফ (কলকাতা)-র ১১ জুলাই ২০১২ সংস্করণ থেকে নেওয়া।

কালীক্ষেত্র একটি ধনুকের মতো দ্বীপ, এর উত্তরে দক্ষিণেশ্বর। দক্ষিণেশ্বরও একটি দ্বীপ ছিল, তা কূর্মাকৃতি বা গোল ধরনের। গঙ্গানদী দক্ষিণেশ্বর দ্বীপের শেষে দু’ভাগে ভাগ হয়ে পূর্ব-ধারা এবং পশ্চিম-ধারায় প্রবাহিত হয়। পূর্ব-ধারা লবণহ্রদে পড়ে সোজা কালীঘাটে গিয়ে বর্তমান আদিগঙ্গায় মিশেছিল। গঙ্গা যে স্থানে দু’ভাগ হয়ে, একটা অংশ বাঁক নিয়ে পূর্ব-ধারায় গিয়েছিল এবং অন্য অংশটি সোজা প্রবাহিত ছিল, সেখানে বাঁকের মুখে একটি বাজার ছিল। বাজারটি নাম পায় ‘বাঁক-বাজার’। সেই বাঁকবাজারই বদলে গিয়ে আজকের বাগবাজার।

কালীক্ষেত্রের চারিদিকেই ছিল গঙ্গা। তবে পূর্বদিকে গঙ্গার সঙ্গে মিলিত হয়েছিল বিদ্যাধরী নদী এবং লবণহ্রদের নোনা জল। পশ্চিম ধারার গঙ্গার জল মিষ্টিজল, এই কারণে প্রাচীন কলকাতার বনভূমি ছিল দু’রকম— লবণহ্রদের দিকে সুন্দরী বৃক্ষ, হেতাল জাতীয় গাছ আর পশ্চিম ধারায় ছিল শিমূল গাছের বনভূমি।

(লেখক কলকাতার ইতিহাস এবং খাদ্য বিষয়ক গবেষক)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE