সকালে দানা বেঁধেছিল জল্পনা। এ বছরের মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল ঘোষণার সময় মধ্যশিক্ষা পর্ষদ প্রথামতো আগামী বছরের পরীক্ষাসূচি ঘোষণা না করায়।
অনেকেই বলতে শুরু করেছিলেন, তবে কি ভোট এগিয়ে আনার কথা ভাবছে রাজ্য সরকার? সেই কারণেই স্থগিত রইল পরীক্ষার দিন ঘোষণা? বিকেলে বিধানসভায় স্বরাষ্ট্র দফতরের বাজেট বিতর্কের উপরে জবাবি বক্তৃতা দিতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য ইঙ্গিত দিলেন, আগামী বছর নির্ধারিত সময়েই, অর্থাৎ মে মাস নাগাদই হবে। যদিও আগাম ভোট নিয়ে জল্পনা মিটল না পুরোপুরি।
মাধ্যমিকের ফল প্রকাশের দিনই পরের বছরের পরীক্ষার সূচি জানিয়ে দেওয়া দীর্ঘদিনের রীতি। কিন্তু শুক্রবার মধ্যশিক্ষা পষর্দের প্রশাসক কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায় জানান, তাঁরা পরীক্ষার দিনক্ষণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। তাই প্রথাভঙ্গ হয়েছে। মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হয় ফেব্রুয়ারি মাসে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এর আগে একাধিক বার ঘনিষ্ঠ মহলে শীতের সময় ভোট হলে ভাল হয় বলে মন্তব্য করেছেন। এই পরিপ্রেক্ষিত মাথায় রেখেই গুঞ্জন শুরু হয়ে যায়, তা হলে কি ভোট কয়েক মাস এগিয়ে আনার ভাবনা থেকেই পর্ষদকে মাধ্যমিকের সূচি প্রকাশ না করার ‘পরামর্শ’ দিয়েছে সরকার? সরকারি সূত্রের খবর, আগামী বছরের পরীক্ষার নির্ঘণ্টের একটি খসড়া পর্ষদের পক্ষ থেকে বিকাশ ভবনে স্কুলশিক্ষা দফতরের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছিল। দফতরের একটি সূত্রের খবর, নবান্নের সবুজ সঙ্কেত না-মেলায় শেষ পর্যন্ত সেই নির্ঘণ্টে সিলমোহর দেওয়া যায়নি। এই কারণেই পর্ষদ পরবর্তী নির্ঘণ্ট প্রকাশ করতে পারেনি।
সরকারের মর্জি বুঝেই সূচি প্রকাশ করা হল না, এমন কথা যে উঠতে পারে, তা বুঝেই অবশ্য বিধানসভা ভোটের সঙ্গে মাধ্যমিকের সূচির কোনও সম্পর্ক নেই বোঝাতে আসরে নামেন পর্ষদ কর্তৃপক্ষ। পরের বারের নির্ঘণ্ট ঘোষণা করতে না-পারাকে নিজেদের ‘ত্রুটি’ বলতেও পিছপা হননি কল্যাণময়বাবু। তিনি বলেন, ‘‘আমরা পরের বারের নির্ঘণ্ট নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। পরীক্ষা আর নির্বাচনের মধ্যে যোগসূত্র তৈরি করলে আমার কিছুই করার নেই। একে যদি আপনাদের পর্ষদের ত্রুটি বলে মনে হয়, তা হলে তা-ই!’’
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক দুই পরীক্ষাতেই বসেন লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রী। পরীক্ষার প্রস্তুতিতেও অনেক সময় লাগে। তাই এক বছর আগে সূচি জানিয়ে দেওয়া দস্তুর। এ বার মাধ্যমিকে তার অন্যথা হওয়ায় প্রাক্তন স্কুলশিক্ষা মন্ত্রী পার্থ দে-র মন্তব্য, ‘‘শাসক দল হয়তো বিধানসভা নির্বাচন এগিয়ে আনতে চায়। তাই পরীক্ষার নির্ঘণ্ট না জানিয়ে নির্বিঘ্নে নির্বাচনের পথই খোলা রাখা হল। ১০ লক্ষেরও বেশি ছেলেমেয়ে মাধ্যমিক দেয়। তাদের উদ্বেগের কোনও দাম নেই দেখা যাচ্ছে!’’
এ দিন বিধানসভার অধিবেশনের উল্লেখ-পর্বে এসইউসি-র শিক্ষক-বিধায়ক তরুণকান্তি নস্কর প্রশ্ন তোলেন, পরের বছরের পরীক্ষার নির্ঘণ্ট কেন প্রকাশ করা হল না? অধিবেশন চলাকালীন সে প্রশ্নের জবাব দেননি শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। পরে তিনি বলেন, ‘‘শুনেছি পরের বারের নির্ঘণ্ট ঘোষণা করা হয়নি। এ রকম কেন হল, তা নিয়ে পর্ষদের সঙ্গে কথা বলব।’’
এর পরে বিধানসভায় তাঁর বক্তৃতায় মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘ভোট এখনও এক বছর বাকি। তার আগে হবে না। এত তাড়াতাড়ি আমরা পালাব না! আপনাদেরও (বিরোধী) পালাতে দেব না!’’ এক দিকে বিধানসভা ভোট এগিয়ে আনার জল্পনা এবং সকালেই পরবর্তী মাধ্যমিকের নির্ঘণ্ট না-জানানো এবং সে দিনই বিধানসভায় হঠাৎ মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণা— এই দুই ঘটনার মধ্যে যোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছেন অনেকে। বিরোধীদের কেউ কেউ বলছেন, মুখ্যমন্ত্রী যে আচমকা এমন ঘোযণা করে দেবেন, তা জানা ছিল না পর্ষদের। তাই তারা পরের বারের পরীক্ষা সূচি ঘোষণা স্থগিত রেখেছিল। আর তা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে বুঝেই পরিস্থিতি সামাল দিতে মুখ্যমন্ত্রী ওই ঘোষণা করেছেন।
শাসক দলের পছন্দমতো দিনে যাতে নির্বাচন হয়, তার জন্য ভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণার আগেই পরীক্ষাসূচিতে বদলের নজির সম্প্রতি তৈরি করেছে জয়েন্ট এন্ট্রান্স বোর্ড। গত ১৮ এপ্রিল জয়েন্টের পরীক্ষার দিন ঘোষণা হয়ে গেলেও শাসক দল ওই দিন কলকাতা পুরসভার নির্বাচন চাওয়ায় আগেভাগে পরীক্ষা পিছিয়ে দেন বোর্ড কর্তৃপক্ষ। ওই দিনই পুরসভা নির্বাচন হবে বলে পরে জানায় রাজ্য সরকার। পর্ষদের এ দিনের পদক্ষেপেও একই সম্ভাবনার জল্পনা তৈরি হয়েছে। পাশাপাশিই, আগামী জুলাইয়ে প্রশাসক হিসেবে কল্যাণময়বাবুর মেয়াদ শেষ হচ্ছে। তৃণমূল জমানায় পর্ষদের একটিও নির্বাচন না হওয়ায় সভাপতির বদলে প্রশাসক নিয়োগ করেই কাজ চালানো হচ্ছে। সামনে নির্বাচনের কোনও সম্ভাবনাও নেই। এই পরিস্থিতিতে কল্যাণময়বাবুকেই ফের প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে বলে সরকারি মহলের খবর। তাই শাসক দলকে ‘তুষ্ট’ করার এই সুযোগ কল্যাণময়বাবু হাতছাড়া করেননি বলে অভিযোগ পর্ষদ-কর্মীদের একাংশের। যদিও প্রশাসক নিজে এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy