বহরমপুর ও মুর্শিদাবাদ জেলা তৃণমূলের সভাপতি অপূর্ব সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়ে কংগ্রেসের প্রাক্তন সংসদ সদস্য অধীর চৌধুরীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে কান্দিতে প্রার্থী দেবেন বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন ভরতপুরের তৃণমূল বিধায়ক হুমায়ুন কবীর। তাঁর সেই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ফের বৈঠকে বসতে চলেছে তৃণমূলের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটি। এ বার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলে বৈঠকে হুমায়ূন নিয়ে হেস্তনেস্ত করতে চায় তৃণমূলের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটি। দলের এমন কঠোর পদক্ষেপের কথা শুনেছেন সদা বিদ্রোহী হুমায়ুন। এ প্রসঙ্গে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় দলকে ‘অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র’ কিংবা ‘কুম্ভকর্ণ’ না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন মুর্শিদাবাদ জেলা তৃণমূলের এই বিতর্কিত নেতা।
হুমায়ুন বলেন, ‘‘কেউ যদি দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে কিংবা দলবিরোধী কাজ করে, তার বিরুদ্ধে অবশ্যই দলের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটি বৈঠক করে ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু, এ ক্ষেত্রে শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির ভূমিকা যেন অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের মতো না হয়। এ ক্ষেত্রে কেবলমাত্র আমার দোষ দেখা হল, আর যাঁরা নিয়মিত দলের বিরুদ্ধে আচরণ করছেন, দলবিরোধী কাজ করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হল না, তা যেন না হয়।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘আমার বিরুদ্ধে দল ব্যবস্থা নিতেই পারে। কিন্তু মুর্শিদাবাদ জেলা তৃণমূলে এমন অনেক পদাধিকারী আছেন, যাঁরা দলবিরোধী কাজ করেছেন, দলের নাম ভাঙিয়ে অন্যায় কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন, কিংবা আমাকে প্রকাশ্যে অসম্মান করেছেন। আমি সব কিছুই আমার দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অফিসকে জানিয়েছিলাম। কিন্তু তাঁদের ক্ষেত্রে কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি। আমার বিরুদ্ধে যদি ব্যবস্থা নিতেই হয়, তা হলে আমি ছাড়া আরও যাঁরা দলবিরোধী আচরণ করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও যেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তাঁদের ক্ষেত্রে দল যেন কুম্ভকর্ণের অবস্থান না নেয়।’’
আক্ষেপের সুরে হুমায়ুনের প্রশ্ন, ‘‘আমি ভরতপুর বিধানসভার বিধায়ক। দু’টি ব্লক নিয়ে সেই বিধানসভা তৈরি, এই দুই ব্লক সভাপতি আমাকে অসম্মান করার জন্য সব রকম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমার ছবিতে ঝাঁটা, জুতো মারা হচ্ছে। আমার ছবিতে জুতোর মালা পরিয়ে রাখা হচ্ছে। বিধায়ক হিসেবে এমন অসম্মান কি আমার প্রাপ্য?’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘ভরতপুর ব্লকের দু’জন সভাপতিকে যেমন আমি একাধিক অভিযোগ জানালেও সরানো হচ্ছে না। তৃণমূল জমানায় নারীপাচার, ছিনতাই, মারধর করার ঘটনায় অভিযুক্ত একজন ব্যক্তিকে বড়ঞা ব্লকের সভাপতি করা হয়েছে। এমন সব ব্যক্তিকে দায়িত্ব থেকে সরানো হোক বলে আমি দাবি করেছি। সব প্রমাণ শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে দিয়েছি। তা সত্ত্বেও তাঁদের বিরুদ্ধে যদি কোনও পদক্ষেপ না হয়, এবং আমাকেই যদি বারবার শাস্তির মুখে পড়তে হয় সে ক্ষেত্রে সঠিক বিচার হচ্ছে বলে কি মনে হবে?’’
সম্প্রতি বহরমপুর-মুর্শিদাবাদ জেলা তৃণমূলের সভাপতি অপূর্বের বিরুদ্ধে একের পর এক বিতর্কিত মন্তব্য করায় হুমায়ুনের উপর বেজায় বিরক্ত তৃণমূল নেতৃত্ব। সম্প্রতি তিনি দাবি করেন, জীবনকৃষ্ণ সাহাকে গ্রেফতারের নেপথ্যে রয়েছেন অপূর্ব। হুমায়ুন আরও বলেন, “আমাকে দল থেকে বার করে দিক, আমি বেরিয়ে যেতে চাই। তার পর আমি দেখাব জেলার রাজনীতি কাকে বলে! ২০২৪ সালে যে অধীর চৌধুরীকে হারিয়েছি, প্রয়োজনে সেই অধীর চৌধুরীর সঙ্গে জোট করে কান্দি বিধানসভায় প্রার্থী দিয়ে বুঝিয়ে দেব।” তাঁর বিরুদ্ধে ফের শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ আলোচনায় উঠেছে। তাই আবার তাঁকে বাগে আনতে বৈঠকে বসতে চলেছে তৃণমূল পরিষদীয় দলের অধীন শৃঙ্খলারক্ষা কমিটি। পরিষদীয়মন্ত্রী তথা দলের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘হুমায়ুনের বক্তব্য আমি শুনেছি। কিন্তু এই বিষয়ে আমি প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করব না। আমি ছাড়াও শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির আরও যে সকল সদস্য রয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেই বৈঠকের আয়োজন করতে হবে। তবে বৈঠকের আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনা করে, তাঁর মতামত নিয়েই বৈঠক করব।’’
এর আগেও ভরতপুরের বিধায়ককে সতর্ক করেছিল তৃণমূল। ২০২২ সালে জেলার দলীয় সভায় প্রকাশ্যে নেতৃত্বের সমালোচনা করার পর প্রথম বার হুমায়ুনকে মৌখিক ভাবে সতর্ক করেন তৎকালীন রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী। পরে ২০২৩ সালে জেলা কমিটি ও ব্লক সংগঠনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে সংবাদমাধ্যমে ক্ষোভ উগরে দেন হুমায়ুন। সেই সময়ে শৃঙ্খলারক্ষা কমিটি তাঁকে লিখিত ভাবে সতর্ক করে এবং দলের অভ্যন্তরীণ বিষয় প্রকাশ্যে না আনার নির্দেশ দেয়। তবুও তিনি প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করায় তাঁকে কারণ দর্শানোর নোটিস পাঠানো হয়। সে বার বক্সীকে লিখিত জবাব পাঠিয়ে ‘শাস্তি’ থেকে বেঁচে যান হুমায়ুন।
২০২৪ সালের মাঝামাঝি আবার এক সভায় জেলা নেতৃত্বকে কটাক্ষ করেন হুমায়ুন। তখনও কমিটি তাঁকে ডেকে মৌখিক ভাবে সতর্ক করে বলে খবর। কিন্তু তাতেও পরিস্থিতি বদলায়নি। বরং ২০২৫ সালের বিধানসভা অধিবেশন চলাকালীন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে অসাংবিধানিক ভাষায় আক্রমণ করায় অস্বস্তিতে পড়ে তৃণমূল। সে বারও ভাষা সংযমের পরামর্শ দিয়ে শো কজ়ের চিঠি ধরান শোভনদেব। পরে বিধানসভায় নিজের ঘরে ডেকে প্রকাশ্যে বিতর্কিত কথা বলা থেকেও বিরত থাকতে হুমায়ুনকে নির্দেশ দেন তিনি। কিন্তু শোভনদেবের ঘর থেকে বেরিয়ে ফের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি দিতে শুরু করে দেন ভরতপুরের এই তৃণমূল বিধায়ক।
এত বার সতর্ক করার পরও যদি শৃঙ্খলাভঙ্গ চলতেই থাকে, তা হলে এ বার দল কী পদক্ষেপ করে— সেই দিকে তাকিয়ে রাজনৈতিক মহল। কারণ, আগামী বছরের বিধানসভা নির্বাচনের কারণে আপাতত দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিয়ে কোনও বিতর্কে জড়াতে নারাজ বাংলার শাসকদল তৃণমূল।