সেও এক পরাভূত আশ্বিনের আখ্যান।
২০০৮। বোধনের দু’দিন আগে সিঙ্গুরে ন্যানো বিসর্জনের বিষাদ ছিটকে আসে চিৎপুর, নতুনবাজার তল্লাটেও। ট্রামরাস্তার ধারের ঘুপচি খোপে অনুচ্চ মানুষটিকে কেউ বলেছিল, সুভাষদা তোমার ন্যানোর টায়ার ফেঁসেই গেল তা হলে! চুঁচুড়ার বাবা পঞ্চাননের শো-কেসে সুভাষ দাসের ছাঁচে গড়া ন্যানো সন্দেশ তখন সাঁ-সাঁ দৌড়চ্ছে। এমন ঠাট্টায় থম মেরে যায় লোকটা! লাগসই জবাব আসে না মুখে। এ সব লোককে সহজেই দু’কথা শুনিয়ে দেওয়া যায়!
বালির নিশ্চিন্দার ঘরেও বৃষ্টির অঝোর ফোঁটার মতো বিঁধত বৌ, ছেলের গঞ্জনা-কাঁটা! কেমন লোক তুমি! একটু নড়ে ঘাস খাবে না! ক’টা টাকা উপায় হয় যে, ছেঁড়া মাদুরে বসে কাঠ ঘষে জীবনটা নষ্ট করলে! আশ্বিনের অকাল বর্ষণে ঘরদোর ভেসে গেলেও কুঁড়ে লোকটা মাদুর ছেড়ে উঠবে না। চোখে কালো ঘষা কাচের হাই পাওয়ার চশমা। স্ট্রোক থেকে কোনওমতে উঠেও নাছোড় ওয়র্ক ফ্রম হোম। আর কোনও কাজ সে পারে না! পুজো, বিজয়ার ছাঁচের কাজ শেষ না হলে দোকানের মুখ থাকবে না!
চিৎপুরে মডার্ন আর্ট কোম্পানির এই হেরো লোকটার হাতের পান ছাঁচে সন্দেশের গায়ে পানপাতার শিরা-উপশিরা চেয়ে থাকত। অবিকল ফুটে উঠত গোলাপ, পদ্মের পাপড়ি। রাখিবন্ধন বা ভাইফোঁটার নির্যাস সামান্য ক’টা রেখার টানে বোঝাতেন। তিন বছর আগে তখন অসুস্থতায় দোকানে যেতে পারেন না! কলকাতার প্যান্ডেলের বুর্জ খলিফার হুজুগ শুনে চুঁচড়োর দোকানকে বুর্জ খলিফা ছাঁচও সুভাষ করে দিয়েছেন।
কাঠের ছাঁচ দশকের পর দশক চললেও দুধ, চিনি, গ্যাসের দামের হেরফেরে সন্দেশের সাইজ় ছোট হয়। ছাঁচও পাল্টাতে হবেই। ছাঁচের মাপে একটু হেরফেরেই মিষ্টির দোকানের বিরাট ক্ষতি! বেশি তাড়া থাকলে সিমলের নকুড় নন্দীর মেজো কত্তা প্রশান্তদা নিজে সুভাষের দোকানে চলে আসতেন! ছাঁচ না-নিয়ে উঠবেন না! ভবানীপুরের এক নাছোড় মিষ্টি-কারবারি মাইনে করা লোক রেখে দেয়, সুভাষদাকে কড়া ম্যানমার্কিংয়ে রাখতে। কাজ শেষ হওয়া অবধি ঠায় বসে থাকবে! রাতে ট্যাক্সিতে সুভাষকে বালির বাড়িতে ছেড়ে তার ছুটি! ফেলু ময়রার অমিতাভ, সুজ্জি মোদকের শৈবালেরা মিলে হুগলিতে একবার সংবর্ধনা দিয়েছিলেন এই পরাজিত মানুষটিকেই। অমিত বলেন, “সুভাষদা সব সময়ে খাঁটি সেগুনের ছাঁচ দিত। শুধু হাসতে হাসতে সন্দেশের কেজি আর ক’টাকা দামের পিস জেনে নেবে! ছাঁচে ৩০-৪০-৫০ গ্রামে নিখুঁত ওজনের সন্দেশে মেশিনও লজ্জা পায়!”
কোনও এক পুজোর আগে নতুনবাজারেই কিছু দোকান চেন্নাই, দিল্লি থেকে ছাপ মারা স্ট্যাম্পের মতো ডাঁটিওলা প্লাস্টিক ছাঁচ আনল। কিন্তু বাংলার সাবেক ছাঁচ-শিল্পের সঙ্গে তুলনা হয় না তার। ভিন্ রাজ্যের কারখানার ছাঁচে ফুল, পাতা, মঙ্গল চিহ্নের নকশা সন্দেশের ছানার গায়ে ডেবে যায়। ওজনও ঠিক থাকে না। সম্পর্কে সুভাষের জ্ঞাতি চিৎপুরের শক্তি আর্ট, লোকনাথ আর্টের কর্তা নারায়ণচন্দ্র দাস বাংলার সন্দেশ ছাঁচেও শিব-শক্তির মিলন দেখেন। ওদের ছাঁচের নকশাটা উঁচু হয়ে থাকে। আমাদের ছাঁচে নকশা অন্তর্লীন। এ ছাঁচে নারীশক্তির উদ্ভাস। কাঠের গায়ে গর্তে আঁকা, লেখা। সন্দেশের গায়ে তা রিলিফ শিল্পের মতো প্রস্ফুটিত হয়। শক্তি ছাড়া শিব হবে না! হেসে বলেন নারান।
চিৎপুরে লোহিয়া হাসপাতাল ও ঘড়িওলা মল্লিকবাড়ির মলিন আভিজাত্য আর সাবেক অ্যালেন মার্কেট ঘেঁষা যৌনপল্লির ক্লান্ত কন্যারা এক অদ্ভুত ত্রিভুজ সৃষ্টি করে। ঠিক এখানেই শাপভ্রষ্ট রাজপুত্রের মতো মিষ্টির ছাঁচ-শিল্পীদের কীটদষ্ট জীবন। দেবীর মূর্তির মাটি সংগ্রহের ঘরদালান আর বিজয়ার মিষ্টি সুখের অবয়ব কয়েক হাত দূরত্বে মিলিয়ে দেয় চিৎপুর।
এ বিজয়ার সম্ভাষণে তবু পদে পদে পরাজয়ের শঙ্কাও। সন্দেশে কর্পোরেট সংস্থার নাম লেখা ‘শুভ বিজয়া’র সৌহার্দ্য ছাঁচ গড়তে পুজোতেও দোকান খোলা রাখে চিৎপুর। শিলিগুড়ি, অসম, গুজরাত পর্যন্ত ছাঁচের জন্য হত্যে দেয়। বাড়ির লক্ষ্মীপুজোর চন্দ্রপুলি বা বিয়ের তত্ত্বের মাছ, প্রজাপতির ছাঁচ আশায় পুজোর ছুটিতে চিৎপুরমুখী এনআরআই বাঙালিও। দেওয়াল-লিখনের অমোঘ সঙ্কেত তবু স্পষ্ট সময়ের ছাঁচে।
মিষ্টির মেশিন যুগে ছাঁচ নির্ভরতা অনেক কমেছে। রাউটারের যন্ত্রের কাজ বা কম্পিউটারে থ্রি-ডি প্রিন্টে জলভরা ছাঁচও হয় আজকাল। তার আদলে মন ভরে না। চন্দননগরের সুজ্জি মোদকেরা ঠোঁট উল্টোয়, সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না! এ বেঢপ জলভরা জলভরাই নয়! চটজলদি সর্বগ্রাসিতার যুগে তবু সবই সয়ে যাচ্ছে।
সুভাষ দাসের দোকানে এখনও পড়ে কাঠের ব্লকে ঠাকুরমার ঝুলির কভার বা পুরনো বিজ্ঞাপন। দাদার যৌবনের স্পর্ধা, ভাই অসীম ফেলতে পারেননি। তখনও ছাপাখানার কাঠ খোদাইয়ের কাজ থাকত। অফসেটযুগে সে কৃৎকৌশল কালের গর্ভে বিলীন। শুধু ছাঁচেও পেট চলে না। কাঠের বারকোশ, কেটো, গণেশের বাক্স, চাকি, বেলন আঁকড়ে বাঁচার চেষ্টা করে ছাঁচ-শিল্পীর জীবন। মেশিন নয়, সমস্যা অন্য জায়গায়! বললেন, চিৎপুরে গত শতকের তুখোড় ছাঁচ-স্রষ্টা বৈদ্যনাথ দাসের পুত্র নারান। “এত ধৈর্যের কাজ করবেটা কে! আজকালকার ছেলেরা একটু খেটেই মোবাইল ঘাঁটে!” গড়পড়তা ছাঁচের দাম ৫০ থেকে ৫০০-৬০০ টাকা। লাভ ছিটেফোঁটাই। জীবনভর কাঠে ঝুঁকে নাগাড়ে কাজের পুরস্কারও, ঘাড়ে ব্যথা, চোখে ছানি আর কাঠের ধুলোয় হাঁপানি! সুভাষচন্দ্র দাস সদ্য গত হয়েছেন মধ্য ষাটেই। দাদার দোকান অসীম কাঁধে নিলেও সুভাষপুত্র দোকানের নামেই তিরিক্ষে। প্রাইভেটের চাকরি নিয়েছে! আর এক জাত-শিল্পী শীতল দাসের প্রয়াণের পরে তাঁর দোকান তালাবন্ধ। বিমান দাস, উজ্জ্বল দাস, দুই ভাই ভোলানাথ, শিবনাথ দাস এ পাড়ায় গুটিকয়েক শিল্পী টিকে। কালনায়, বোলপুরে তবু প্রাণপণে নতুন প্রতিভার খোঁজকরেন নারান।
বিজয়ার প্রস্তুতিতে পূর্বনারীর স্পর্শ মাখা ছাঁচ-স্মৃতি হানা দেয় ঘরে ঘরে। ভীম নাগের ঘরের প্রদীপ নাগও শকুন্তলা সন্দেশের ছাঁচটায় হাত বুলিয়ে আদর করেন। বলেন, “শুধু কী পাক, ছাঁচের গায়ে সূক্ষ্ম প্যাঁচের টানেই ফোটা ফুলের মতো রূপ খোলে শকুন্তলার! জানি না, এমনটি আর কে গড়ে দেবে!” ছাঁচের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে বহু সন্দেশই! চিৎপুরে পাথুরেঘাটার পুজোর থিমে এ বার বটতলার কাঠ খোদাই আর লিথো ছাপের গল্প। হারানো সময়ের ছাঁচে জাতিস্মর হয় কলকাতা। পুজোর হোর্ডিংয়ে ঢাকা ছাঁচ-শিল্পীর জীবন।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)