Advertisement
E-Paper

মতুয়া ভোট ঘিরে বঙ্গে ‘বিরল’ টানাপড়েন শুরু, সরাসরি মাঠে নামল মতুয়া মহাসঙ্ঘও, কত কেন্দ্রে ঠাকুরবাড়ির প্রভাব?

বিধানসভা ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণা হতে এখনও মাস আটেক বাকি। কিন্তু মতুয়া ভোট ঘিরে যুযু‌ধান দু’পক্ষের তৎপরতা তুঙ্গে। দু’পক্ষই জানে, রাজ্যের ১০০টি বিধানসভা আসনে মতুয়া ভোটারদের ‘উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি’ রয়েছে।

Motua Vote Bank matters in Bengal, BJP-TMC starts rare tug of war around Motua voters almost 8 months ahead of poll announcement

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০২৫ ০৮:৫৯
Share
Save

মহাকরণের অলিন্দ থেকে ‘রেড কার্পেট’ সরিয়ে ‘সবুজ গালিচা’ বিছিয়ে দেওয়ার অন্যতম কারিগর ছিল রাজ্যের ৬৮টি তফসিলি বিধানসভা আসন। তফসিলি জাতির জন্য সংরক্ষিত সেই আসনগুলির মধ্যে ২০১১ সালের ভোটে ৪৮টি পেয়েছিল কংগ্রেস-তৃণমূল জোট। সেগুলির মধ্যে যেগুলিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল মতুয়া সমাজের, সেখানে জোটের সাফল্যের হার ছিল আরও বেশি। ৯০ শতাংশেরও বেশি মতুয়া আসন গিয়েছিল জোটের ঝুলিতে। কিন্তু গত ১০ বছরে সেই মতুয়া ভোট ধীরে ধীরে সরেছে বিজেপির দিকে। তার ‘ছায়া’ পড়েছে অন্যান্য তফসিলি এলাকাতেও। এই ‘প্রবণতা’ যে বিপজ্জনক, তা বিলক্ষণ জানেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই প্রবণতা ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য মমতা যে সক্রিয়, তার খবর রাখে বিজেপি। ফলে বঙ্গের ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণার অনেক আগে থেকেই টানাপড়েন শুরু হয়েছে রাজ্যের মতুয়া ‘ভোটব্যাঙ্ক’ ঘিরে।

পশ্চিমবঙ্গে মতুয়া সম্প্রদায়ের মোট জনসংখ্যা আড়াই থেকে পৌনে তিন কোটি বলে মতুয়া মহাসঙ্ঘের পদাধিকারী তন্ময় বিশ্বাস, সুখেন্দ্রনাথ গাইনদের দাবি। সংগঠনের হিসাব অনুযায়ী রাজ্যে মতুয়া ভোটারের সংখ্যা ১ কোটি ৮০ লক্ষের আশেপাশে। ৪২টি লোকসভা আসনের মধ্যে অন্তত ১২টিতে মতুয়া সমাজের ‘উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি’ রয়েছে বলে মহাসঙ্ঘের পদাধিকারীদের দাবি। বনগাঁ, রানাঘাট, কৃষ্ণনগর এবং ব্যারাকপুর লোকসভা আসনে সেই উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি। ‘অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘ’-এর সঙ্ঘাধিপতি তথা কেন্দ্রীয় জাহাজ প্রতিমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুরের হিসাব অনুযায়ী, রাজ্যের ১০০টি বিধানসভা আসনে মতুয়া ভোটারদের ‘উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি’ রয়েছে। বিভিন্ন ভোট পরবর্তী সমীক্ষার ফলাফল বলছে, সেই ১০০-টির মধ্যে অন্তত ২১টি আসনে মতুয়া ভোটই সংখ্যাগরিষ্ঠ।

মতুয়াপ্রধান এলাকা ঘিরে এই হিসাব কষার রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গে আগে ছিল না। একটা সময়ে এই আসনগুলি কংগ্রেসের দখলেই যেত। মতুয়া মহাসঙ্ঘের সাবেক প্রধান প্রমথরঞ্জন ঠাকুর ১৯৬২-’৬৩ সালে কংগ্রেস সরকারের মন্ত্রীও ছিলেন। পরে টানা কয়েক দশক ধরে ওই আসনগুলির অধিকাংশ বামফ্রন্ট জিততে থাকে। কিন্তু বার বার মতুয়া ঠাকুরবাড়িতে রাজনীতিকদের যাতায়াতের ছবি তখনও সে ভাবে দেখা যায়নি। ২০০৯ সালের যে লোকসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গে বামেরা ধরাশায়ী হয়, তার অব্যবহিত আগে থেকেই মতুয়া ‘ভোটব্যাঙ্ক’ নিয়ে চর্চা বাড়তে শুরু করে। ঠাকুরবাড়িতে তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতার গতায়াত শুরু হয়। তৃণমূলের অন্দরে সকলে জানেন যে, মতুয়া ভোটের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়ার জন্য দলনেত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। ঠাকুরবাড়ি ঘিরে পাল্টা তৎপরতা দেখিয়ে বামেরাও হারানো ভোট ফেরানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু লাভ হয়নি। ২০১১ সালের ভোটে গাইঘাটা বিধানসভায় মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর এবং ২০১৪ সালের ভোটে বনগাঁ লোকসভায় কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর তৃণমূলের প্রার্থী হয়ে জেতেন। মঞ্জুল রাজ্যের মন্ত্রী হন। কপিল সাংসদ হওয়ার বছরখানেকের মধ্যে প্রয়াত হওয়ায় তাঁর স্ত্রী মমতাবালা ঠাকুরকে উপনির্বাচনে জিতিয়ে তৃণমূল সংসদে পাঠায়। কালক্রমে মতুয়া সমাজ তৃণমূলের অন্যতম ‘ভোটব্যাঙ্ক’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে।

তবে তৃণমূলের সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির ‘সামগ্রিক’ সুসম্পর্ক বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ২০১৪ সাল থেকে মতুয়া ভোটে বিজেপির অংশীদারি বাড়তে শুরু করে। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপি প্রার্থী বনগাঁয় প্রায় আড়াই লক্ষ ভোট পান। ২০১৫ সালের যে উপনির্বাচনে মমতাবালা বনগাঁ লোকসভা থেকে জিতেছিলেন, সেই ভোটে ঠাকুরবাড়ির আড়াআড়ি বিভাজন প্রকাশ্যে চলে আসে। জোড়াফুলের মমতাবালার বিরুদ্ধে ‘পদ্ম’ প্রতীক নিয়ে লড়তে নামেন তাঁরই দেবর মঞ্জুলের জ্যেষ্ঠপুত্র সুব্রত ঠাকুর। সুব্রত জিততে পারেননি। কিন্তু বিজেপির ভোটপ্রাপ্তি ৩ লক্ষ ছাড়িয়ে যায়।

মতুয়া সমাজে বিজেপির এই প্রভাব বাড়তে শুরু করার পরেও কিন্তু তৃণমূল মতুয়াভূমিতে নিজেদের নির্বাচনী সাফল্য ধরে রেখেছিল। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধে বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেস জোট বেঁধে লড়ে। কিন্তু সেই নির্বাচনেও তফসিলি জাতির জন্য সংরক্ষিত আসনগুলির মধ্যে ৪৯টিতেই জিতেছিল তৃণমূল। বাম-কংগ্রেস পায় ১৯টি। ওই আসনগুলির মধ্যে মতুয়াপ্রধান আসনগুলিতে তৃণমূলের সাফল্যের হার ছিল আরও বেশি। মতুয়াপ্রধান ২১টি আসনের মধ্যে ১৯টিতেই সে বছর জেতে তৃণমূল। মাত্র দু’টি যায় বাম-কংগ্রেসের দখলে।

তবে তার পর থেকে রাজ্যে প্রধান বিরোধী শক্তি হিসাবে বিজেপির উত্থান শুরু হয়। তফসিলি তথা মতুয়া এলাকায় তৃণমূলের সাফল্যের হার কমতে থাকে। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তফসিলি জাতির জন্য সংরক্ষিত আসনগুলির মধ্যে তৃণমূল জিতেছিল ৩৬টিতে। বিজেপি ৩২টিতে। ২১টি মতুয়াপ্রধান আসনের মধ্যে তৃণমূল জিতেছিল ১২টি। বিজেপি ৯টি। বস্তুত, ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপির টিকিটে বনগাঁয় শান্তনু ঠাকুর এবং রানাঘাটে জগন্নাথ সরকারের জয়ের সময় থেকে মতুয়া এলাকায় ভোটবিন্যাসের এই ছবি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। দু’বছর পরের বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যের অন্যান্য প্রান্তে হিসাব বদলে গেলেও মতুয়াপ্রধান এলাকায় আগের হিসাবই প্রায় বহাল থাকে। সাম্প্রতিকতম (২০২৪ সালের লোকসভা) ভোটের ফলও বলছে, বিধানসভা আসনভিত্তিক হিসাব কষলে ২০১৯ সাল থেকে শুরু-হওয়া প্রবণতাই মতুয়া এলাকায় এখনও বহাল রয়েছে।

সেই প্রবণতায় ধাক্কা দিতে চায় তৃণমূল। মতুয়া ভোটের উপরে প্রায় এক দশক যে ‘একচ্ছত্র আধিপত্য’ তৃণমূল ধরে রেখেছিল, ২০২৬ সালের ভোটে মমতা তা ফিরে পেতে চাইছেন। তাই ওই এলাকায় বার বার ধাক্কা খেয়েও মমতাবালাকে রাজ্যসভায় পাঠিয়ে তিনি তৃণমূলের অন্দরে মতুয়া জনপ্রতিনিধিত্ব রেখেছেন। মমতাবালার কন্যা মধুপর্ণা ঠাকুরকে বাগদা বিধানসভার উপনির্বাচনে টিকিট দিয়ে জিতিয়ে এনেছেন। ‘মতুয়া উন্নয়ন বোর্ড’ গড়ে মমতাবালাকে তার মাথায় বসিয়েছেন।

তৃণমূলের পরিকল্পনা আঁচ করেই মতুয়া ভোটারদের ঘিরে ‘তৎপরতা’ আরও বাড়াচ্ছে বিজেপি। মতুয়া ভোট ধরে রাখতে সরাসরি মতুয়া মহাসঙ্ঘকে ময়দানে নামানো হয়েছে। গত ১২ জুন কলকাতায় মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক (সিইও) মনোজকুমার আগরওয়ালের সঙ্গে দেখা করে স্মারকলিপি জমা দিয়েছে মহাসঙ্ঘ। সেখানে লেখা হয়েছে, ‘ভোটার তালিকা থেকে বেছে বেছে মতুয়াদের নাম বাদ দেওয়া হচ্ছে’। তার কারণ হিসাবে স্মারকলিপিতে লেখা হয়েছে—১. মতুয়ারা সিএএ সমর্থন করেছেন। ২. মতুয়ারা সনাতন ধর্ম এবং সনাতন সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের সংরক্ষণে সক্রিয়। ৩. আরজি কর কাণ্ড, এসএসসি কাণ্ড-সহ অপশাসন ও দুর্নীতির নানা ঘটনায় মতুয়ারা রাজ্যের বর্তমান শাসকের কঠোর সমালোচনা করেছেন।

প্রসঙ্গত, মতুয়াদের নাম ভোটার তালিকা থেকে ‘বেছে বেছে’ বাদ দেওয়ার অভিযোগে বিজেপি কয়েক মাস ধরেই সরব। ইতিমধ্যেই একাধিক বার নির্বাচন কমিশনকে তারা লিখিত অভিযোগও জানিয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের কাছেও সে অভিযোগ পৌঁছেছে। গত ১ জুন নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে আয়োজিত কর্মী সম্মেলনে শাহ বলেন, ‘‘মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর আমায় জানিয়েছেন, ভোটার তালিকা থেকে হিন্দুদের নাম কেটে দেওয়া হচ্ছে। আমি তাঁকে বললাম, ভয় পাবেন না। যাঁদের নাম কাটার নোটিস এসেছে, তাঁরা সিএএ-তে আবেদন করুন, আমি তাঁদের নাগরিকত্ব দেব।’’

বিধানসভা ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণা হতে এখনও মাস আটেক বাকি। কিন্তু মতুয়া ভোট ঘিরে যুযু‌ধান দু’পক্ষের তৎপরতা তুঙ্গে। দু’পক্ষই জানে, রাজ্যের ১০০টি বিধানসভা আসনে মতুয়া ভোটারদের ‘উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি’ রয়েছে। বিভিন্ন ভোট পরবর্তী সমীক্ষার ফলাফল বলছে, সেই ১০০টির মধ্যে অন্তত ২১টি আসনে মতুয়া ভোটই সংখ্যাগরিষ্ঠ।

Motua Community vote bank politics All India Motua Mahasangha Election Commission BJP TMC West Bengal Politics

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে আপনার সাবস্ক্রিপশন আপনাআপনি রিনিউ হয়ে যাবে

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।