কার নাম বাদ গেল, কার নাম থাকল, সে সবের প্রাথমিক হিসেব আসবে খসড়া ভোটার তালিকায়। তবে এখনও পর্যন্ত যা প্রবণতার হদিস মিলছে, রাজ্যে ভোটার তালিকায় নাম ধরে রাখতে বিশেষ তৎপরতা দেখা যাচ্ছে সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত নানা এলাকায়। বাইরের প্রচার এবং মাটির তথ্যের ফারাক বাড়ছে!
ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) প্রক্রিয়ায় এক কোটির বেশি নাম বাদ পড়বে বলে আগাম ঘোষণা করে রেখেছেন বিজেপি নেতৃত্ব। সীমান্ত পেরিয়ে এসে পশ্চিমবঙ্গে আস্তানা গেড়ে বসা অনুপ্রবেশকারীদের দলে দলে পলায়ন করতে হবে, এই হুঙ্কারও প্রতিনিয়ত শোনা যাচ্ছে বিজেপি ও তাদের প্রভাবিত নানা সংগঠনের কর্মসূচিতে। শেষ পর্যন্ত কত নাম ভোটার তালিকা থেকে খসে যাবে, তা এখনও স্পষ্ট না-হলেও এসআইআর-এ ‘এনুমারেশন ফর্ম’ বা গণনা-পত্র পূরণ করে বেশি সংখ্যায় ফেরত আসছে সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত বিভিন্ন এলাকা থেকেই। নির্বাচন কমিশনের তথ্য এবং তৃণমূল কংগ্রেস ও সিপিএমের অন্দরের খবর এই মর্মে মিলে যাচ্ছে। গণনা-পত্র পূরণের নিরিখে পরিস্থিতি যেখানে দাঁড়িয়ে, তাতে শাসক শিবিরের অন্দরে আপাতত স্বস্তি। কারণ, সংখ্যালঘু এলাকায় বুথ লেভল অফিসারদের (বিএলও) সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা করে গণনা-পত্র পূরণ করে দিচ্ছেন স্থানীয় মানুষ। পক্ষান্তরে সীমান্তবর্তী বনগাঁ এলাকায় গণণা-পত্র পূরণের হার অনেক কম। সেখানে মতুয়া-সহ নমঃশূদ্রদের বাস এবং সাম্প্রতিক কালে তাঁরা বিজেপির ভোট-ব্যাঙ্ক। বাইরে এসআইআর বিরোধিতায় কড়া সুর ধরে রাখলেও শাসক শিবিরের অন্দরে অন্তত এখনও পর্যন্ত আতঙ্কের স্রোতের কারণ নেই!
বিএলও মারফত কমিশনে জমা পড়া তথ্য এবং তৃণমূলের সাংগঠনিক স্তরে উঠে আসা তথ্য মেলালে দেখা যাচ্ছে, গণনা-পত্র পূরণের নিরিখে এখনও পর্যন্ত সব চেয়ে এগিয়ে জঙ্গিপুর লোকসভা এলাকা। যে জঙ্গিপুর সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) এবং ওয়াকফ সংশোধনী আইনের প্রতিবাদে হিংসায় উত্তপ্ত হয়েছে, সেখানেই এসআইআর এগোচ্ছে দ্রুত গতিতে! তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, মুর্শিদাবাদ জেলাতেই এসআইআর-‘আতঙ্কে’ এখনও অবধি ৬ জন ভোটারের মৃত্যুর অভিযোগ করেছে তৃণমূল। কিন্তু সেই জেলাতেই সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত একের পর এর বিধানসভা কেন্দ্রে গণনা-পত্র পূরণের কাজ বেশি হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে সংখ্যালঘু-অধ্যুযিত দুই জেলা মালদহ ও মুর্শিদাবাদে এসআইআর সংক্রান্ত বার্তা দিতে যাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সব ঠিক থাকলে আগামী ৩ ডিসেম্বর মালদহে ও ৪ তারিখ (গণনা-পত্র জমার শেষ দিনে) বহরমপুরে সভা করার কথা তৃণমূল নেত্রীর।
এখনও পর্যন্ত ৯০%-এর বেশি গণনা-পত্র জমা পড়েছে বসিরহাট, কোচবিহার, রায়গঞ্জ (উত্তর দিনাজপুর) লোকসভা এলাকায়। এর প্রতিটিতেই সীমান্ত এলাকা এবং সংখ্যালঘু ভোটার রয়েছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যায়। মালদহে জমা হয়েছে ৮৮%-এর বেশি। সংখ্যালঘু-প্রধান নয়, এমন এলাকার মধ্যে বাঁকুড়া ও পূর্ব বর্ধমান ৯০% পেরিয়েছে। অন্য দিকে, মতুয়া-গড় বলে পরিচিত বনগাঁয় সেই হার ৪৫%। মতুয়া সম্প্রদায়ের উপস্থিতি রয়েছে নদিয়া জেলার রানাঘাটেও। তবে সেখানে গণনা-পত্র পূরণের হার তুলনায় বেশি, ৭০%-এর উপরে। বর্ধমান-দুর্গাপুর ও আসানসোল লোকসভা মিলিয়ে পশ্চিম বর্ধমানের অংশে জমা পড়েছে ৪৫.৫% এবং কলকাতা দক্ষিণে ৪৭%। কলকাতা উত্তরে ওই হার এখনও ৩২%। নির্বাচন কমিশনের হিসেব অনুযায়ী, রাজ্যে ৭ কোটি ৬৬ লক্ষ ভোটারের প্রায় ৮৮%-এর গণনা-পত্র জমা পড়ে শুক্রবার পর্যন্ত ডিজিটাইজ়েশন হয়ে গিয়েছে।
তৃণমূল নেতাদের মতে, এসআইআর হলেই মমতার সরকার বিপাকে পড়ে যাবে, বিজেপির এমন দাবি বাস্তবে মিলছে না। কমিশন পর্যাপ্ত সময় দেয়নি, তথ্য আপলোডে নানা সমস্যা আছে। সে সবের মধ্যেও বিশেষত সংখ্যালঘু এলাকায় গণনা-পত্র পূরণের অগ্রগতি ভাল। দিল্লিতে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমারের সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে তৃণমূলের নেতা-সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন, শতাব্দী রায়, মহুয়া মৈত্রেরাও দাবি করেছেন, তাড়াহুড়ো ও আতঙ্কের কারণে বিএলও এবং ভোটারদের মৃত্যুর দায় কমিশনের। তাঁদের প্রশ্ন, অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত করাই উদ্দেশ্য হলে অসম, ত্রিপুরা-সহ সীমান্তবর্তী অন্যান্য রাজ্যে এখন এসআইআর হল না কেন?
সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের মতে, ‘‘মৃত ও ভুয়ো ভোটার অবশ্যই বাদ যাওয়া উচিত। প্রতি বছর ভোটার তালিকা সংশোধনে কমিশন ঠিকমতো কাজ করলে এসআইআর দরকারই হয় না! অনুপ্রবেশের ক্ষেত্রেও সংখ্যার নানা হেরফের করা হচ্ছে মুখের কথায়, একটা সম্প্রদায়কে নিশানা করা হচ্ছে। তবে আমরা যা বুঝতে পারছি, নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সংখ্যালঘু মানুষ বরং কাগজপত্র হাতে রাখায় অনেক বেশি সতর্ক।’’
বিজেপি অবশ্য তাদের সুরই বজায় রাখছে। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর দাবি, ‘‘অনুপ্রবেশকারীরা তৃণমূলের ভোট-ব্যাঙ্ক। তাদের বাঁচানোর জন্য শাসক দল সব রকম চেষ্টা করছে। এমনকি, রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের মারফত জেলা ও বিধানসভা কেন্দ্রের নির্বাচনী আধিকারিকদের (ডিইও, ইআরও) উপরে চাপ দেওয়া হচ্ছে কোনও নাম বাদ না দেওয়ার জন্য!’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)