Advertisement
০৫ মে ২০২৪
রোগীর পরিবারের থেকে টাকা তো মেলেই, কমিশন ডাক্তারের থেকেও

ভিন্ ‌রাজ্যে চিকিৎসায় তাঁরাই গাইড

কখনও গন্তব্য আরও দূরে, চেন্নাই বা বেঙ্গালুরুর হাসপাতালে। অচেনা শহর, অপরিচিত মানুষ, অজানা ভাষা। গ্রামের সেই লোকেরা হয়তো চেনা চৌহদ্দির বাইরে কখনও পা রাখেননি।

ব্যতিক্রমী হালিমা। নিজস্ব চিত্র

ব্যতিক্রমী হালিমা। নিজস্ব চিত্র

কল্লোল প্রামাণিক
তেহট্ট শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০১৮ ০৭:০০
Share: Save:

প্রত্যন্ত গ্রামের গুরুতর অসুস্থ রোগীকে নিয়ে বাড়ির লোক দেখাতে যাবেন কলকাতার হাসপাতালে। কখনও গন্তব্য আরও দূরে, চেন্নাই বা বেঙ্গালুরুর হাসপাতালে। অচেনা শহর, অপরিচিত মানুষ, অজানা ভাষা। গ্রামের সেই লোকেরা হয়তো চেনা চৌহদ্দির বাইরে কখনও পা রাখেননি। শিক্ষার জোরও হয়তো খুব বেশি নয়। ধরা যাক ততটা চটপটে, চৌখশও নন। ফলে রোগী নিয়ে বাস-ট্রেন বদলে ডাক্তার-হাসপাতালে কী ভাবে দৌড়ঝাঁপ করবেন, ভেবেই তাঁরা শঙ্কিত, দিশেহারা। তখনই মুশকিল আসানের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন তাঁরা। কোনও নির্দিষ্ট নাম নেই তাঁদের কাজের। কিন্তু তাঁরাই হলেন গ্রামের মানুষের একটা বড় অংশের চিকিৎসা-গাইড।

নদিয়া জুড়ে বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছেন এই ‘গাইড’ রা। গ্রামের কাউকে চিকিৎসার জন্য দূরের শহরে নিয়ে যেতে হলে অনেকেই এঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। টাকার বিনিময়ে রোগী ও তাঁর সঙ্গীদের সঙ্গে নিয়ে ট্রেনে-বাসে চেপে কলকাতা বা অন্য রাজ্যের হাসপাতালে চলে যান তাঁরা। বহু বার সেখানে যাতায়াতের সূত্রে চিকিৎসক, হাসপাতাল কর্মী থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট, থাকা-খাওয়ার জায়গা সবই চেনা থাকে তাঁদের। ফলে সুবিধা হয় রোগীপক্ষের। কোনও-কোনও ‘গাইড’ টাকা নেন দিনের হিসাবে আবার কেউ ১৫ দিন বা ১ মাস—যত দিন থাকতে হয় ততদিন পর থোক টাকা নেন। সেই সঙ্গে থাকা-খাওয়া-যাতায়াত ভাড়া সবই রোগীর বাড়ির লোকের পকেট থেকে গচ্চা হয়। রোজগারের অন্য একটা পথও এই‘গাইড’দের অনেকের রয়েছে। রোগী এনে দেওয়ার বিনিময়ে নির্দিষ্ট কিছু হাসপাতাল ও ডাক্তারের থেকে বাঁধা কমিশন পান তাঁরা।

করিমপুরের লক্ষ্মীপাড়ার নীলাদ্রি পাড়িওয়াল, অভয়পুরের উত্তম মণ্ডল, নাটনা গ্রামের সাধন মণ্ডলেরা প্রায় ১০-১২ বছর ধরে এই কাজ করছেন। বছর ছেচল্লিশের নীলাদ্রির কথায়, ‘‘বেঙ্গালুরুতে রোগী নিয়ে সবচেয়ে বেশি যাতায়াত করি আমি। সাধারণত এক সঙ্গে তিন-চার জন রোগী ও তাঁদের আত্মীয়দের নিয়ে রওনা হই। এক জন হলে পড়তায় পোষায় না।’’ আবার সাধন মণ্ডল বলেন, ‘‘তিন-চার জন রোগী নিয়ে মাসখানেকের জন্য চেন্নাই বা বেঙ্গালুরু গেলে প্রত্যেকের কাছ থেকে ৪-৫ হাজার টাকা করে মোট ১৪-১৫ হাজার টাকা একটি ট্যুর-এ রোজগার হয়। থাকা-খাওয়া ফ্রি।’’ কয়েক মাস আগে নীলাদ্রি-র সঙ্গে নিজের অসুস্থ আত্মীয়কে নিয়ে বেঙ্গালুরুতে চিকিৎসা করিয়ে এনেছেন দেবেন সুতার। বললেন, ‘‘অচেনা শহরে হাসপাতাল-ডাক্তার খুঁজতে সমস্যা হয়নি। কোথায় হোটেল, কোথায় ব্যাঙ্ক, কোথায় সস্তায় খাবার সব উনিই দেখিয়ে দিয়েছেন। ডাক্তারদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছেন। আমরা এত সব পারতামই না।’’

আবার ব্যতিক্রমী এমন এক-আধ জনও রয়েছেন যাঁরা স্বেচ্ছায়, নিখরচায় এই ‘চিকিৎসা গাইড’-এর পরিষেবা দিচ্ছেন। যেমন, পলাশিপাড়ার বারুইপাড়া গ্রামের বাসিন্দা সত্তর ছুঁইছুঁই হালিমা মণ্ডল। গ্রামের লোক ও আত্মীয়রাই জানালেন, দীর্ঘ প্রায় ১৭ বছর ধরে হালিমা রোগী নিয়ে কৃষ্ণনগর, বহরমপুর বা কলকাতার হাসপাতালে দৌড়ে যাচ্ছেন। বিয়ের পর সংসার করতে পারেননি বেশি দিন। এখন মাসের পঁচিশ দিনই এলাকার রোগীদের চিকিৎসা করাতে হাসপাতালে কিংবা নার্সিংহোমে
দিন কাটান।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Health Medical
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE