Advertisement
০৮ মে ২০২৪

কচিমুখে হাসি ফেরাল বোনাস

জিয়াগঞ্জের আশ্রমটা গঙ্গার ধারে। বেশ নিরিবিলি। খান তিরিশেক বাচ্চা থাকে। সকলেই অনাথ। এদের কেউ জন্মের পর বাবা-মাকে হারিয়েছে, কেউ আবার জন্ম থেকেই পরিচয়হীন।

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

ছন্দক বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:৫৯
Share: Save:

—‘‘সাবধানে সুপ্রিয়দা, ওদিকটা কিন্তু ভীষণ পিছল।’’

কাদায় ভরা উঠোনটায় কতকগুলো থান ইট কেউ আলগোছে বিছিয়ে রেখেছে। পর পর সাজিয়ে রাখা সেই ইটে সন্তর্পণে পা ফেলে এগোচ্ছিল সুপ্রিয়। ইপ্সিতার কথায় আরেকটু সাবধানী হয়ে হাঁটতে লাগল। এক-দুই-তিন—আস্তে আস্তে আশ্রমের বারান্দার সিঁড়িটার নাগাল পেল সুপ্রিয়। তাকে জল-কাদার মধ্যে এখানে টেনে আনার জন্য বেশ লজ্জিত দেখাচ্ছিল ইপ্সিতাকে। সেটা বুঝতে পেরেই পরিবেশটা কিছুটা হালকা করে দেওয়ার চেষ্টা করল সুপ্রিয়। ‘‘যাই বলো ইপ্সিতা, সবুজে ভরা এমন জায়গায় ক’টা দিন কাটালে সারা বছরের খাটাখাটনির রসদটা জুটে যেত।’’ তার কথায় মুচকি হাসল ইপ্সিতা। কথাটা যে এমনি বলা, বেশ বুঝতে পারল সে। সত্যি! এমন একটা দিনে মানুষটাকে এখানে আসতে বলা তার একেবারে ঠিক হয়নি।

রাজ্য সরকারি দফতরে গত ১৫ বছর ধরে চাকরি করছে সুপ্রিয়। বহরমপুরে ওদের অফিস। ইপ্সিতা ওর সহকর্মী। কিছুদিন আগে তাদের অফিসে জয়েন করেছে। বছর পঁচিশ বয়স। মিষ্টি স্বভাবের মেয়েটাকে প্রথম দেখাতেই ভাল লেগে গিয়েছিল সুপ্রিয়র। সকলের সঙ্গে সহজে মিশতে পারে। ক’দিনেই অফিসের সকলকে আপন করে নিয়েছে সে। দু’-একবার কথা বলার পর সুপ্রিয় বুঝে গিয়েছিল, এ মেয়ে অন্যদের চেয়ে আলাদা। গত কয়েক বছর ধরে জিয়াগঞ্জের কাছে একটা অনাথ আশ্রমের সঙ্গে সে যুক্ত। সেখানেই প্রতি মাসে মাইনের একটা বড় অংশ দান করে সে। সুপ্রিয় দেখত, মাসের পয়লা তারিখ যেদিন তাদের মাইনে হয়, সেদিন অফিস থেকে একটু আগেই বেরিয়ে যায় ইপ্সিতা। অফিসে চেনামুখ হয়ে যাওয়ার পর একদিন সরাসরিই ইপ্সিতাকে প্রশ্নটা করে বসেছিল সুপ্রিয়। তখনই এই আশ্রমের কথা জানতে পারে সে। সেদিন থেকেই জিয়াগঞ্জের এই আশ্রমে ঘুরতে আসার ইচ্ছেটা মনে মনে পুষে রেখেছে ও।

অবশেষে আজ সেই দিন। আজ ওদের মাইনে আর পুজোর বোনাস দেওয়ার দিন ছিল। সকালে বাড়ি থেকে বেরনোর সময় সুপ্রিয়র আট বছরের মেয়ে দিতিপ্রিয়া তাকে বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে সে কথা। ‘‘বাবা আজ খাগড়া বাজার থেকে আমায় পালাজো কিনে দেওয়ার কথা মনে আছে তো!’’ এদিকে, তাড়াতাড়ি অফিস ছুটি হয়ে যাওয়ায় আজই ইপ্সিতা ওকে জিয়াগঞ্জে যাওয়ার জন্য বললে। প্রথমে একটু দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিল সুপ্রিয়। পরে ভেবে দেখল, মেয়েকে না হয় কাল-পরশু পালাজো কিনে দেওয়া যাবে।

জিয়াগঞ্জের আশ্রমটা গঙ্গার ধারে। বেশ নিরিবিলি। খান তিরিশেক বাচ্চা থাকে। সকলেই অনাথ। এদের কেউ জন্মের পর বাবা-মাকে হারিয়েছে, কেউ আবার জন্ম থেকেই পরিচয়হীন। পৃথিবীর আলো দেখার পর কেউ হয়তো ওদের আস্তাকুঁড়ে ফেলে গিয়েছিল। বাচ্চাগুলোকে দেখার জন্য রয়েছে জনাচারেক মহিলা। ইপ্সিতাকে দেখে বাচ্চাগুলো ঘিরে ধরল। সঙ্গে আনা ব্যাগ থেকে ওদের হাতে চকলেট, খেলনা তুলে দিল সে। সেই সময় ওর মুখটা দেখতে হয়! প্রতিটা রেখায় মাতৃত্বের আনন্দ ঝিলিক দিচ্ছিল। সুপ্রিয়কে হাসতে দেখে ইপ্সিতা শিশুর চাপল্যে বলে উঠল, ‘‘জানো সুপ্রিয়দা, এখানে ওদের দেখে কী যে ভাল লাগে। সারাদিন হাসি-মজায় কাটিয়ে দিই। হুস করে দিনটা ফুরিয়ে যায়।’’ বাচ্চাগুলোকে দেখার পর থেকে একটা প্রশ্নই ঘুরেফিরে মনে আসছিল সুপ্রিয়র— আচ্ছা, এই যে সর্বজনীন পুজোগুলোয় এত জাঁকজমক, এত টাকা খরচ হয়, ওরা কি পারে না, বাজেট কাটছাঁট করে শিশুগুলোর মুখে একটু হাসি ফোটাতে! গরিব-দুঃখীদের সাহায্য করার কথা কই আটত্রিশ বছরের জীবনে ওর নিজেরও তো একবারও মনে হয়নি। এমন আমি-সর্বস্ব দুনিয়ার ও-ও যে একজন, সেটা ভেবে নিজেকে মনে মনে ধিক্কার দিল সুপ্রিয়। ইপ্সিতার প্রতি ওর সম্মান অনেক গুণ বেড়ে গিয়েছে আজ এখানে আসার পর।

গোটা দিনটা বাচ্চাগুলোর সঙ্গে হইহই করে কাটাল ওরা দু’জন। ফিরে আসার সময়, আগে থেকে ভেবে রাখা কাজটা করে ফেলল সুপ্রিয়। বোনাসের পুরো টাকাটা সে তুলে দিল ইপ্সিতার হাতে। ইপ্সিতা বিস্ময় নিয়ে তাকাতে সুপ্রিয় বললে, ‘‘এগুলো দিয়ে বাচ্চাগুলোকে নতুন জামা কিনে দিও। সামান্য ক’টা টাকা। কিছুই হবে না।’’ ‘‘কিন্তু তোমার মেয়ের পালাজো, বৌদির শাড়ি...’’ ইপ্সিতাকে মাঝপথে থামিয়ে দিল সুপ্রিয়। ‘‘ওদের তো অনেক আছে। এ বারটা না হয় সেগুলো দিয়েই চালাক।’’ আর কিছু বলতে পারল না ইপ্সিতা। শুধু, তার মুখের হাসি বুঝিয়ে দিচ্ছিল, ‘সুপ্রিয়দা’কে চিনতে সে একটুও ভুল করেনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Child Home Durga Puja 2019
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE