Advertisement
১৬ অক্টোবর ২০২৪

শান্ত কাশ্মীরে গোলমালের খবরে চোখে জল প্রণবের

১৯ অগস্ট, সোমবার বিশ্ব ফটোগ্রাফি দিবস। স্মৃতি ঘেঁটে নদিয়ার বরেণ্য ফটোগ্রাফারদের গল্প ফিরিয়ে আনছে আনন্দবাজার। প্রকৃতিই তাঁর প্রেম, আর ভালবাসার রং সাদা-কালো। তাই তাঁর তোলা বেশির ভাগ ছবিও সাদা-কালো। ‘‘রঙিন ছবিতে সব কিছু যেন কোথায় হারিয়ে যায়’’, বলেন প্রণব। বাবা রেলে চাকরি করতেন। তাই বেড়ানোর অভ্যেসটা সেই ছোটবেলা থেকেই।

কাশ্মীর তখন শান্ত। ডান দিকে, প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র

কাশ্মীর তখন শান্ত। ডান দিকে, প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র

সুদীপ ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১৯ অগস্ট ২০১৯ ০৩:১৫
Share: Save:

রানাঘাটের সিদ্ধেশ্বরীতলায় হালকা গোলাপি রঙের বাড়িটার দোতলায় দক্ষিণ-পূর্বের জানলা দিয়ে দিনের প্রথম আলো এসে পড়েছে।

খাটে বসে সেই আলোয় খবরের কাগজ‌ে চোখ বুলিয়ে বিরক্ত মুখে নবতিপর প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সেই ’৭২ সালে আমি প্রথম কাশ্মীর যাই। কী তার শোভা! কত ভাল সেখানকার মানুষ। এখন কাগজ খুললে কাশ্মীরের যা গোলমালের পরিস্থিতি দেখছি, তাতে চোখে জল আসে। কাগজ পড়তেই ইচ্ছে হয় না।’’

অত্যন্ত আবেগ নিয়ে এক গোছা ছবির মধ্যে থেকে ১৯৭২ সালে সাদা কালো নেগেটিভে তোলা ১৫ বাই ১২ মাপের প্রিন্ট করা কাশ্মীরের শেষনাগ অঞ্চলের একটা ছবি দেখিয়ে বৃদ্ধ বলেন, ‘‘এই সেই কাশ্মীর। কী সুন্দর, কী শান্ত!’’ তার পরেই ঝলমলে মুখে তিনি যোগ করেন, ‘‘একটা রুকস্যাক, একটা স্টোভ, ছোট্ট একটা প্রেশার কুকার আর ক্যামেরা সঙ্গী করে গোটা চারেক জায়গা বাদ দিয়ে ভারতের পুরোটাই বেড়ানো হয়ে গিয়েছে।’’

প্রকৃতিই তাঁর প্রেম, আর ভালবাসার রং সাদা-কালো। তাই তাঁর তোলা বেশির ভাগ ছবিও সাদা-কালো। ‘‘রঙিন ছবিতে সব কিছু যেন কোথায় হারিয়ে যায়’’, বলেন প্রণব। বাবা রেলে চাকরি করতেন। তাই বেড়ানোর অভ্যেসটা সেই ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু বদলির চাকরিতে পড়াশোনা ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তাঁর। জন্ম ১৯২৯ সালের ২৩ জুন।

প্রথমে রানাঘাটের লালগোপাল স্কুল, কলকাতার সেন্ট পলস স্কুলে বছর দুয়েক পড়ে, বাবার সঙ্গে প্রণব চলে যান অসমের বোনারপাড়ায়। সেখানে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন তিনি। কিন্তু ১৯৪৭ সালে যে বছর ম্যাট্রিক দেওয়ার কথা, দেশ ভাগ হয়ে বোনারপাড়া বাংলাদেশের মধ্যে পড়ে। মাত্র ১২ ঘণ্টার নোটিসে চলে আসতে হয় অসমের শিমলাগুড়িতে।

পড়াশুনার সেখানেই ইতি। পরে অবশ্য চাকরি জীবনে প্রাইভেটে স্কুল ফাইনাল আর ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। ওই ১৯৪৭ সালেই ঠাকুর্দা মারা গেলে, মায়ের সঙ্গে রানাঘাটের ঘটকপাড়ার বাড়িতে পাকাপাকি ভাবে চলে আসেন তাঁরা। বাবা ফিরে যান কর্মস্থলে। এর পর ওয়েস্ট বেঙ্গল ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার্সের প্রশিক্ষণ নিয়ে কিছু দিনের জন্য কল্যাণীর ক্যাম্পে ইনস্ট্রাক্টরের কাজ করেন। তার পরে অন্ডালের কাজোরা গ্রামের কয়লাখনিতে কাজ করেছিলেন কিছু দিন। ১৯৫১ সালে রেলে চাকরি পান। বছরে দু’বার করে ছুটি নিয়ে একা একাই বেড়িয়ে পড়তেন। প্রথমে ১২০ মিমি ফরম্যাটের ফিল্ম ক্যামেরায় ছবি তুলেছেন, পরে ৩৫ মিলিমিটারের ফিল্ম ক্যামেরায়, আর এক দম শেষে যখন ফিল্ম দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠল তখন একটা ডিজিটাল ক্যামেরা কেনেন বাধ্য হয়েই। বিভিন্ন জায়গায় নিসর্গ দৃশ্য সাদা-কালো রঙে ছবি হয়ে ধরা পড়েছে তাঁর ক্যামেরায়।

‘‘মানুষের ছবি তুলে তেমন আনন্দ পাইনি, যা পেয়েছি প্রকৃতির ছবিতে’’, বলেন প্রবীণ। চলার পথের টুকরো-টুকরো স্মৃতি আজও নাড়া দেয় তাঁকে। যেমন বেশ মনে আছে, এক বার কুলু যাওয়ার রাস্তায় একটা স্লাইড ফিল্ম কুড়িয়ে পান। সেই প্রথম স্লাইডে ছবি তোলা তাঁর। আর এক বার পণ্ডিচেরীতে (এখন পুদুচেরি) ক্যামেরার ব্যাগ হারিয়েছিলেন। ক্যামেরা হারানোয় তাঁর যতটা না দুঃখ হয়েছিল, তার থেকে অনেক বেশি দুঃখ পেয়েছিলেন যে ছবিগুলো ওই ক্যামেরায় বন্দি করেছেন সেগুলো হারিয়ে যাওয়ায়।

আজীবন আপন খেয়ালে ছবি তুলেছেন, কোনও দিন স্বীকৃতি নিয়ে ভাবেননি। তবুও এক বার বন্ধুদের আবদারে গোয়ার এক প্রতিযোগিতায় ছবি পাঠিয়ে ২০০১ টাকা পুরস্কার পেয়েছিলেন, আর বার কয়েক কলকাতা আর পণ্ডিচেরীতে তার ছবির প্রদর্শনী হয়েছিল। ১৯৯৮ সাল থেকে ‘ফটোগ্রাফি অ্যাসোসিয়েশন অব রানাঘাট’ ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত। বর্তমানে তিনিই ক্লাবের সভাপতি।

এক মাত্র ছেলে প্রেসিডেন্সি কলেজের জীববিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। কলকাতায় থাকতে হয় তাঁকে। এখন সিদ্ধেশ্বরীতলার বাড়িতে একাই থাকেন প্রণব। সারা দিনের কাজ বলতে ক্লাবের কয়েক জন আসেন, ছবি নিয়ে নানা কথা হয়। ৯০ বছর বয়সেও তরতাজা যুবক তিনি। সারা রানাঘাট তাঁকে ‘তিনুদা’ নামেই চেনে। নিয়ম করে রোজ ব্যায়াম করেন আর রাস্তায় হাঁটেন। আর প্রতি রাতে ডায়েরি লেখাটা সেই ১৯৫১ সাল থেকে তাঁর অভ্যেস।

বেড়ানোর নেশা আজও পিছু ছাড়েনি প্রণবের। এই তো কয়েক মাস আগেই নাতির সঙ্গে লাদাখ ঘুরে এলেন। ‘‘আমার ইচ্ছে, যে ক’টা জায়গা বাকি আছে, নাতিকে নিয়ে ঘুরে আসব সম্ভব হলে’’ — বলে ফুরফুর করে হাসেন তিনুদা।

অন্য বিষয়গুলি:

Photographer Photography Kashmir Article 370
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE