ছাত্র সংখ্যা সাড়ে তিনশো ছুঁইছুঁই। কিন্তু ফরাক্কার জোড় পুকুরিয়া জুনিয়র হাই স্কুলে শিক্ষক রয়েছেন মাত্র দু’জন। তাঁদের পক্ষে পঠন-পাঠন সুষ্ঠু ভাবে চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ছিল। কিন্তু শিক্ষা দফতর এ ব্যাপারে তেমন কোনও পদক্ষেপ না করায় বাধ্য হয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির ১৫৫ জন পড়ুয়াকে ‘ট্রান্সফার সার্টিফিকেট’ ধরিয়েল দিয়েছেন। পড়ুয়াদের মাইল চারেক দূরের নিউ ফরাক্কা হাই স্কুল, আমতলা হাই স্কুল বা তুলসীপুকুর জুনিয়র হাই স্কুলে ভর্তির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
২০১০ সালে অনুমোদন মিললেও শিক্ষকের অভাবে বেশ কিছুদিন চালুই হয়নি ওই স্কুলটি। বছর দু’য়েক পর ২০১২ সালে এলাকারই ২ জন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষককে নিয়ে চালু হয় স্কুলটি। তৈরি করা হয় দু’টি শ্রেণিকক্ষও। পরের বছর একজন অতিথি শিক্ষক স্কুলে যোগ দেন। তিন জন শিক্ষক নিয়ে কোনও রকমে চলছিল ওই স্কুল। কিন্তু মাস সাতেক আগে একজন শিক্ষকের চাকরির মেয়াদ ফুরোলে সমস্যা চরম আকার নেয়। দু’জন শিক্ষকের পক্ষে অত পড়ুয়াকে পড়ানো কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ে।
স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জগন্নাথ দাসের দাবি, “অত কম শিক্ষক দিয়ে স্কুল চালানো যাচ্ছিল না। তাই আমরা সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির সকল পড়ুয়াকে অন্য স্কুলে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিয়েছি।” তিনি বলেন, ‘‘বছর দু’য়েক পরেই ওই পড়ুয়ারা মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। এখন থেকে গুণমানসম্পন্ন শিক্ষা না পেলে ওরা মাধ্যমিকে ভাল ফল করবে কী করে?” তিনি আরও বলেন, “ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে এমনটা করা হয়েছে। শিক্ষক চেয়ে জেলার শিক্ষা আধিকারিকদের কাছে বার বার দরবার করেও কোনও কাজ হয়নি। তাই গ্রামবাসী ও অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনা করেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”
২০০৯ সালের শিক্ষার অধিকার আইন অনুযায়ী, জুনিয়র হাই স্কুলের ক্ষেত্রে ৩৫ জন ছাত্র পিছু একজন করে শিক্ষক থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে অনেক স্কুলেই মানা হয় না এই অনুপাত। জোড় পুকুরিয়া স্কুল শিক্ষক ঘটতির জন্যই দু’টি শ্রেণির পড়ুয়াদের অন্যত্র ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। আইন অনুযায়ী, জুনিয়ার হাই স্কুলের কোনও পড়ুয়াকে বাড়ি থেকে দু’কিলোমিটারের মধ্যে কোনও স্কুলে শিক্ষার সুযোগ দিতে হবে। এক্ষেত্রে পড়ুয়াদের যেতে হবে বাড়ি থেকে অন্তত চার মাইল দূরের কোনও স্কুলে। আর্থিক ভাবে পিছিয়ে এই গ্রামে বছর চারেক আগে তৈরি হয় ওই জুনিয়র হাই স্কুলে। তারপর পড়ানোর জন্য শিক্ষকের খোঁজ শুরু হয়। গ্রামেই স্কুল তৈরি হওয়ায় এলাকার ছেলেমেয়েদের পড়াশোনায় জোয়ার আসে। কিন্তু আবার পড়াশোনার জন্য দূরের স্কুলে যেতে হওয়ায় স্কুলছুট হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন অনেকেই।
স্কুলেরই শিক্ষক মহম্মদ হাসমত হোসেন বলেন, “অনেক কষ্ট করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ১২৪ জন পড়ুয়াকে নিয়ে স্কুলটি শুরু করেছিলাম। কিন্তু এখন শিক্ষকের অভাবে দু’টি ক্লাসের পড়ুয়াদের অন্য স্কুলে পাঠাতে বাধ্য হলাম। দিন আনি দিন খাই ঘরের পড়ুয়ারা দূরের স্কুলে কত দিন পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারবে সেটাই প্রশ্ন।”
স্কুলগুলিতে শিক্ষক যে সঙ্কট চলছে তা স্বীকার করেছেন জঙ্গিপুরের সহকারি বিদ্যালয় পরিদর্শক পঙ্কজ পাল। তিনি বলেন, ‘‘জোড় পুকুরিয়া স্কুলের শিক্ষকেরা তাঁদের পরিস্থিতির কথা জানিয়েছিলেন। দু’জনের পক্ষে ওই সংখ্যক ছাত্রকে পড়ানো অসম্ভব। তাই ছাত্রদের স্বার্থেই পড়ুয়াদের অন্য স্কুলে ভর্তির পরামর্শ দিয়েছেন শিক্ষকরা। বিষয়টি রাজ্য শিক্ষা দফতরকে জানিয়েছি।”
শুধু জোড় পুকুরিয়াই নয়, জেলার বহু জুনিয়র হাই স্কুলেই শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কোনও রকমে চলছে স্কুলগুলি। রমাকান্তপুর জুনিয়র হাই স্কুলে ৩৫২ জন ছাত্র-ছাত্রী থাকলেও শিক্ষক রয়েছেন মাত্র একজন। একই অবস্থা দস্তামারাতেও। সেখানে তিনশো ছাত্র রয়েছে। কিন্তু শিক্ষক রয়েছেন মাত্র একজন। প্রদীপ পাঠশালা জুনিয়র হাই স্কুলে পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত চারটি ক্লাসে পড়ুয়া রয়েছে ৩১১ জন।
কিন্তু শিক্ষক সংখ্যাও সাকুল্যে ২। একজন চলতি বছরের জুন মাসে অবসর নেবেন। জেলা জুড়ে এভাবে অসংখ্য জুনিয়র হাই স্কুলে শিক্ষকের অভাব থাকলেও শিক্ষা দফতরের এ ব্যাপারে কোনও হেলদোল নেই বলে অভিযোগ। জেলা শিক্ষা দফতর বাড়তি শিক্ষকদের ঘোষণা করলেও তা বাস্তবায়িত হয় না বলে আক্ষেপ অনেক জুনিয়র হাই স্কুল কর্তৃপক্ষের। ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy