রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের দফতরে (সিইও) বিক্ষোভের পরে কলকাতার নগরপালকে সতর্ক করে সব আধিকারিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলেছিল জাতীয় নির্বাচন কমিশন। তার পরেও শনিবার কমিশনের বৈঠক চলাকালীন বৈঠক-স্থলের বাইরে ‘বিএলও অধিকার রক্ষা কমিটি’ নামে বুথ লেভল অফিসারদের (বিএলও) একটি সংগঠনের বিক্ষোভ ঘিরে ধুন্ধুমার বাধল। গত সোমবার থেকে দফায় দফায় বিক্ষোভ দেখাচ্ছে সংগঠনটি। রাজ্যের ‘স্পেশাল রোল অবজ়ারভার’ সুব্রত গুপ্ত-সহ জেলাভিত্তিক ১২ জন পর্যবেক্ষক এ দিন বৈঠকে যোগ দেওয়ার পরে বিক্ষোভের তীব্রতা বেড়েছে। রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক (সিইও) মনোজ আগরওয়ালের গাড়ির সামনেও চলে বিক্ষোভ। পাশাপাশি, ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধনের (এসআইআর) জেরে ‘আতঙ্কে’ অপমৃত্যু, অসুস্থতার অভিযোগকে সামনে রেখে রাজনৈতিক তরজাও অব্যাহত রয়েছে।
এরই মধ্যে গায়ে আগুন দেওয়ার ফলে পুড়ে মৃত্যু হয়েছে পূর্ব বর্ধমানের ভাতারের মস্তুরা খাতুন কাজি (৪১) নামে এক মহিলার। মৃতার দিদি আসতুরা বিবির দাবি, “বোন ভেবেছিল, এসআইআর-ফর্ম জমা দিলে লক্ষ্মীর ভান্ডার, রেশনের চাল পাবে না! গত কাল জোর করে ফর্ম জমা দেওয়া হয়েছে। মনে হচ্ছে, আতঙ্কিত হয়ে বোন আত্মঘাতী হয়েছে।” সংশ্লিষ্ট বিএলও শফিকুল ইসলাম মণ্ডল জানিয়েছেন, ২০০২-এর তালিকায় নাম থাকা মস্তুরাকে জানানো হয়েছিল, ফর্ম জমা না-দিলে অনেক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। এই আবহে রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস বলেছেন, “প্রায় ৪৫ জন মানুষ আত্মহত্যা করলেন। আর কত রক্তপাত হলে বিজেপি, নির্বাচন কমিশন এটা বন্ধ করবে?” মৃতের বাড়িতে গিয়ে পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন যুব তৃণমূলের সভানেত্রী, সাংসদ সায়নী ঘোষ।
বেঙ্গল চেম্বারে কমিশনের বৈঠক চলাকালীন এ দিন বাইরে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন কমিটির সদস্যেরা। সিইও-সহ অন্য আধিকারিকেরা বৈঠক শেষে বেরোনোর সময়ে তাঁদের গাড়ির সামনেও বিক্ষোভ দেখানো হয়েছে। পরে পুলিশের হস্তক্ষেপে উল্টো দিকে থাকা তাঁর দফতরে ঢোকেন সিইও-সহ অন্যেরা। বিক্ষোভকারীরাও চলে আসেন সিইও দফতরের বাইরে। সেই সময়ে পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে তাঁদের এক জন সদস্য আহত হয়েছেন বলে দাবি কমিটির। আন্দোলনকারীরা কাজের চাপ কমানো, এসআইআর-প্রক্রিয়ার সময় বাড়ানো এবং মৃত বিএলও-দের পরিবারকে ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছেন। বিক্ষোভে যোগ দেওয়া মৃত বিএলও-দের পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন অতিরিক্ত সিইও।
কমিশনের বক্তব্য, বার বার বলা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনগুলি বিএলও-মৃত্যু সংক্রান্ত রিপোর্ট এখনও পাঠায়নি। ফের তা চাওয়া হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, জেলা প্রশাসন রিপোর্ট দেওয়ার পরে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি বিবেচনার জন্য দিল্লিতে পাঠানো হয়। পাশাপাশি, কমিশনের পরামর্শ, বিএলও-দের বর্ধিত সাম্মানিক-অর্থ দ্রুত মঞ্জুর করুক রাজ্য। এরই মধ্যে কলকাতায় চিকিৎসাধীন মেদিনীপুর সদরের এক বিএলও-র চিকিৎসার জন্য কমিশনের কাছে আর্থিক সহায়তা চেয়ে আবেদন জানিয়েছে পরিবার।
যে আধিকারিকদের পর্যবেক্ষক হিসাবে নিয়োগ করেছে কমিশন, তাঁরা ‘টাইট’ দেবেন বলে উল্লেখ করে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর আর্জি, “এই দলটি দ্রুত ব্লক অফিসগুলিতে যাক।” তাঁর সংযোজন, “তিন দিনে তৃণমূলের ভোট-কৌশলী সংস্থা বিডিও-দের সাহায্যে, বিএলও-দের প্রভাবিত করে ২০-২৫ লক্ষ মৃত, ভুয়ো, বাংলাদেশি মুসলিম-সহ এক কোটি ভোটারকে ডিজিটাইজ় করেছে। আমরা ‘স্পেশাল অডিটে’রদাবি জানাচ্ছি।”
তবে দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) জ্ঞানেশ কুমরাকে কলকাতায় এসে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে হবে বলে ফের দাবি তুলেছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য। বিএলও-‘চাপে’র প্রশ্নে বিজেপিকেই দায়ী করেছে তৃণমূল। দলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ বলেছেন, “বিএলও-দের আতঙ্কিত করেছেন শুভেন্দুরা। বিহারের প্রসঙ্গ টেনে সরকারি কর্মীদের গ্রেফতার, চাকরি থেকে বরখাস্ত হবেন বলে ভয় দেখাচ্ছেন।”
তৃণমূল ও বিজেপি, দু’পক্ষকেই নিশানা করেছে সিপিএম। কোচবিহারে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেছেন, “ভোটের আগে কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসক দল ভয়ের আবহ তৈরি করে। কেউ ৫৬ ইঞ্চি হয়ে বা কেউ হিজাব পরে বলেন, আমিই বাঁচাব, আর কেউ বাঁচাবে না। মানুষকে ভয় থেকে বাঁচাতে হবে বামপন্থীদের।”
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)