Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

উত্তর জুড়ে হুজুগের দুধ খাচ্ছে নন্দী

পুলিশ প্রশাসনের কেউ কেউ বলছেন, ১৯৯৫ সালে গণেশের ‘দুধপানের’ সময়ে আরএসএস বিষয়টিকে ‘দৈবী চমৎকার’ আখ্যা দিয়ে প্রচার করতে চেয়েছিল। কিন্তু সে সময়ে হালে পানি পায়নি।

অবাক-‘দুধপান’: তপনের হলিদানা গ্রামেও নন্দীর দুধ-পানের গুজব রটেছে। —নিজস্ব চিত্র

অবাক-‘দুধপান’: তপনের হলিদানা গ্রামেও নন্দীর দুধ-পানের গুজব রটেছে। —নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
বৈষ্ণবনগর ও তপন শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০১৯ ০৪:৩৩
Share: Save:

চব্বিশ বছর আগে গণেশের দুধ খাওয়ার হুজুগে তোলপাড় হয়েছিল গোটা দেশ। সেই স্মৃতিই যেন ফিরে এল উত্তরবঙ্গে। এ বারে অবশ্য গণেশ নয়, মহাদেবের বাহন নন্দীর দুধ খাওয়ার গুজব ছড়াল দুই জেলায়। কয়েক দিন আগে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার তপন ব্লকের ‌হলিদানা এলাকার রাজ রাজেশ্বরী মন্দিরে নন্দীকে দুধ খাওয়ানোর হুজুগ দেখা যায়। বৃহস্পতিবার একই হুজুগ দেখা গিয়েছে মালদহের বৈষ্ণবনগর এলাকার পারলালপুরের মন্দিরে, আলিপুরদুয়ারের মথুরা চা বাগানে। দার্জিলিং জেলার জোড়বাংলোর একটি শিবমন্দিরেও শিবের দুধপান নিয়ে হুজুগের খবর মিলেছে। বিজ্ঞান মঞ্চ অবশ্য দাবি করেছে, এটা গুজব ও কুসংস্কারের ফল। তাঁদের ব্যাখ্যা, পৃষ্ঠটানের মতো নানা কারণে এই ঘটনা ঘটতে পারে।

সম্প্রতি ছেলেধরা নিয়ে গুজবের জেরে উত্তরবঙ্গের একটি বড় অংশ জুড়ে গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে। গত দু’দিনে তার সঙ্গে যোগ হয়েছে চোর সন্দেহে মারধর। এই সমস্যা সামলাবেন কী করে, তাই নিয়ে এর মধ্যেই বিভিন্ন জেলা প্রশাসন যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। এ বার তার সঙ্গে যোগ হল নন্দীর ‘দুধ খাওয়ার’ হুজুগ। পুলিশ প্রশাসনের কেউ কেউ বলছেন, ১৯৯৫ সালে গণেশের ‘দুধপানের’ সময়ে আরএসএস বিষয়টিকে ‘দৈবী চমৎকার’ আখ্যা দিয়ে প্রচার করতে চেয়েছিল। কিন্তু সে সময়ে হালে পানি পায়নি। এখন পশ্চিমবঙ্গে, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে সঙ্ঘের প্রভাব যথেষ্ট। তাই দুধপানের ঘটনা থেকে নতুন কী জটিলতা তৈরি হতে পারে, তা নিয়ে যথেষ্ট চিন্তিত প্রশাসনের লোকজনেরা।

মালদহ প্রশাসন সূত্রে খবর, বৈষ্ণবনগর ও মোথাবাড়ি বেশ কয়েকটি শিবমন্দিরে ‘দুধ খাওয়ার’ খবর মিলেছে। বুধবার সকালে প্রথম দেখা যায়, স্থানীয় বাসিন্দারা ঘটি, বাটি করে দুধ নিয়ে হুড়োহুড়ি করে নন্দীকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন। বৃহস্পতিবার সকাল থেকেও ছিল একই দৃশ্য। বৈষ্ণবনগরের পারলালপুরের শিবমন্দিরে এ দিন ভিড় উপচে পড়ছে। দূর-দূরান্ত থেকে লোক আসতে শুরু করে। মেলা বসে যায়।

একই ছবি দক্ষিণ দিনাজপুরের হলিদানা গ্রামেও। শ্রাবণ মাস বলে প্রতি সোমবার সেখানকার শিবমন্দিরে মেলা বসছে। গত সোমবার সেখানে এক ভক্ত দুধ নিয়ে নন্দীর পাথরের মূর্তিতে ঠেকান। স্থানীয়দের দাবি, তখন পাত্র থেকে দুধ শেষ হয়ে যায়। তাতেই স্থানীয়দের ধারণা হয়, নন্দী দুধ খাচ্ছে।

বিশ্বাস: পারলালপুর শিব মন্দিরে নন্দীকে দুধ খাওয়াচ্ছেন ভক্ত। নিজস্ব চিত্র

বিজ্ঞান মঞ্চের লোকজন এর মধ্যেই বিষয়টি নিয়ে পাল্টা সচেতনতা প্রচারের কথা ভাবছে। এই ঘটনার যাবতীয় ‘অলৌকিকত্বকে’ খারিজ করে দিয়ে মালদহ জেলা বিজ্ঞান মঞ্চের সদস্যরা জানান, এমন বুজরুকি রুখতে এলাকায় গিয়ে সচেতনতা শিবির করবেন তাঁরা। ওই মঞ্চের সম্পাদক সুনীল সরকার বলেন, “এটি একেবারেই বিজ্ঞান। সারফেস টেনশন বা পৃষ্ঠটানের জন্য অনেক সময়ে এই ধরনের ঘটনা ঘটে। আবার অনেক পাথরে যে ছোট ছোট ফুটো থাকে, সেগুলিও তরল শুষে নেয়। আমরা এই ধরনের অজ্ঞতা, অন্ধবিশ্বাস এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে যাব।’’ বালুরঘাটের বিজ্ঞান ও পরিবেশ কর্মী তুহিনশুভ্র মণ্ডলও বলেন, ‘‘গণেশ, শিব কিংবা নন্দী মূর্তির দুধ শুষে নেওয়ার পিছনে বিজ্ঞান হল, ‘ক্যাপিলারি অ্যাকশন’ ও ‘সারফেস টেনশান’। বিষয়টি নিয়ে সচেতনতার প্রচার করা হবে।’’

১৯৯৫ সালে ‘গণেশের দুধপানের’ হুজুগে যখন গোটা দেশ মেতে ওঠে, তখনও ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বিজ্ঞানি, গবেষক এবং বিজ্ঞান মঞ্চের সদস্যরা বলেছিলেন, মূলত এই পৃষ্ঠটানের জন্যই একই রকম পাথরে তৈরি যে কোনও মূর্তির গায়ে দুধ, কেরোসিন, এমনকি সাবান জলের মতো তরল ঠেকিয়ে ধরলে তা-ও ‘খেয়ে নেবে’ ওই মূর্তি।

বিজ্ঞান মঞ্চের মতো কোনও কোনও জেলা প্রশাসনও সচেতনতা প্রচার শুরু করার কথা জানিয়েছে। মালদহের অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) অশোক মোদক বলেন, ‘‘সংশ্লিষ্ট বিডিও, গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধানকে পদক্ষেপ করতে বলা হবে। সচেতনতার প্রচারও করা হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Nandi Milk North Bengal Tapan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE