E-Paper

রায়ে মানবিক দৃষ্টিকোণে অথর্ব হত না স্কুলও

সমস্ত শুরুর একটা শেষ আছে। পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষাক্ষেত্রে যাবতীয় নিয়োগ দুর্নীতি কাঠগড়ায়। সে দিনের শুনানি তাই যেন কফিনে শেষ পেরেক।

উদয় সাহা

শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০২৫ ০৯:৪২
—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

একটা ঐতিহাসিক শুনানি। শীর্ষ আদালতের বিবেচনায় ‘টেন্টেড’ ও ‘আনটেন্টেড’। দীর্ঘ একটি বিচার প্রক্রিয়া শেষ হল। চাকরিহারা হলেন প্রায় ছাব্বিশ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকা। এক মুহূর্তে তুলকালাম। এক মুহূর্তে তছনছ। লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষার মানচিত্র। প্রতিটি চাকরিহারা পরিবারের মাথায় ভেঙে পড়ল আকাশ।

পুরো প্যানেল বাতিল বলে ঘোষণা করা হল৷ তা হলে কি এই রায় অনিবার্য ছিল? নিয়োগে ভেজাল চিহ্নিত কর‍তে গিয়ে কোপ পড়ল নির্দোষ-স্বচ্ছ আরও কত শিক্ষকের কাঁধে। আমরা ছোট থেকে পড়েছি, ‘দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতা কাঁদে যবে, সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার’। তা হলে কই, সে রকম কিছু আমরা দেখতে পেলাম না। শীর্ষ আদালত তার ‘সুপ্রিম’ ক্ষমতা প্রয়োগ করে কেন পারল না তার শুনানিতে ভারসাম্য বজায় রাখতে।

সমস্ত শুরুর একটা শেষ আছে। পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষাক্ষেত্রে যাবতীয় নিয়োগ দুর্নীতি কাঠগড়ায়। সে দিনের শুনানি তাই যেন কফিনে শেষ পেরেক। ফাঁকা ওএমআর শিটের গল্প আবালবৃদ্ধবনিতা জানেন। আদালতের আদেশনামা শুনলে ভীষণ ভাবে পরিষ্কার হয়ে যায়, পর্দার আড়ালের কাহিনি সব। কমবেশি আমাদের প্রত্যেকেরই ‘চক্ষু চড়কগাছ’। দিনের শেষে তা-ও কোথাও গিয়ে মনে হয়, কোনও ভাবেই কি এড়ানো যেত না এ রকম এক রায়।

যে বিভাজনের এর কথা আলোচ্য হয়ে উঠেছে, সুপ্রিম কোর্টও ব্যর্থ হল সেই কাজে। অথচ নতুন করে পরীক্ষায় অনুমতি দেওয়া হল ‘যোগ্য’দের। সুদ-সহ টাকা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ বহাল থাকল ‘অযোগ্য’দের জন্য৷ মজার বিষয় ঠিক এখানেই। আপাত ‘যোগ্য’ ঘোষণা করার পরেও ফের তাঁদেরই যেন বলির পাঁঠা করা হল৷ এ যেন ঠিক একটি বেঞ্চের কয়েক জনকে শাস্তি দিতে গিয়ে শিক্ষক ক্লাসঘর থেকে বার করে দিলেন সব পড়ুয়াদেরই।

যে কোনও ঘটনার দুটো দিক বা প্রভাব থাকে৷ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ৷ ছাব্বিশ হাজার চাকরি বাতিল হওয়া যদি প্রত্যক্ষ প্রভাব বলি, তা হলে তার পরোক্ষ দিক মারাত্মক, ভয়াল এবং ভীষণ। পথে বসে যাওয়ার উপক্রম। ছাব্বিশ হাজার শিক্ষক মানে ছাব্বিশ হাজার পরিবার। এ বার একের সঙ্গে গড়ে চার জন ধরলে যে সংখ্যা দাঁড়ায়, তাঁদের আজ সকলের মাথায় হাত। একটা চাকরি শুধু প্রাত্যহিক দিন গুজরান নয়৷ জীবনে প্রতিষ্ঠিত হলে সকলেই গুটি গুটি পায়ে হেঁটে যান স্বপ্নপূরণের দিকে। আর সেই সঙ্গে জুড়ে যায় সংসার, চিকিৎসা, জীবনদায়ী ঔষধ, প্রতি মাসের ব্যাঙ্কের ঋণ শোধ। এখানে আমোদ-প্রমোদ বা বিনোদন সরিয়েই রাখলাম। শীর্ষ আদালতের শুনানি যেন হরপা বানে সবারই পায়ের নিচের মাটি কেড়ে নিল।

এ বার যদি রাজ্যের স্কুলগুলির কথা ভাবি, তা হলে বলতে হয়, গাছের ডাল যেন আরও নুইয়ে গেল। অদ্ভুত শূন্যতা তৈরি হল প্রতিটি স্টাফরুমে। একটা স্থবিরতা যার কোনও অনুবাদ নেই৷ ক্ষতিগ্রস্ত হল প্রতি দিনের টাইম-টেবল। খুব সম্প্রতি উচ্চ প্রাথমিক স্তরে শিক্ষক-শিক্ষিকারা কাজে যোগদান করলেও, ২০১৬-র নিয়োগ কেন্দ্র করে শীর্ষ আদালতের এই শুনানির ফলে অথর্ব হয়ে উঠতে পারে রাজ্যের প্রতিটি স্কুলের পড়াশোনা। আমাদের প্রিয় ছাত্রছাত্রীদের কথা ভাবলে মনে হয়, আরও কিছুটা মানবিক দৃষ্টিকোণ এবং খুঁতশূন্যতা প্রয়োজন ছিল দাঁড়িপাল্লায়।

লেখক: শিক্ষক

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

SSC Supreme Court

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy