E-Paper

ভালবেসে পিঠেপুলি তৈরির সময় কোথায়?

‘আউনি বাউনি কোথাও না যেও, তিন দিন ঘরে বসে পিঠেপুলি খেও’— গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে একসময় মকর সংক্রান্তি উদযাপন শুরু হতো এই সুরেই।

দেবদত্তা বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০২৫ ০৯:১০
পিঠের নানা আকার গড়তে গড়তে সকাল থেকে সন্ধ্যে হত উনুনের ধারে বসে থাকা বাড়ির রন্ধন পটিয়সী রমণীর।

পিঠের নানা আকার গড়তে গড়তে সকাল থেকে সন্ধ্যে হত উনুনের ধারে বসে থাকা বাড়ির রন্ধন পটিয়সী রমণীর। —ফাইল চিত্র।

পৌষ মাস। মাঠে পাকা ধান। ‘সোনালি রত্ন’ ঘরে তুলে ঢেঁকির শব্দে যে শ্বেতশুভ্র সামগ্রী বাঙালির ঘরে ঘরে এ সময় নানা পদে রসনা নিবৃত্তির সহায়ক, তার প্রতি বাঙালির নস্ট্যালজিয়া সেই কোন অতীত থেকেই। নানা লোককথা, সূর্যের উত্তরায়ন শুরুর দিন হিসেবে মকর সংক্রান্তি সমগ্র আর্যাবর্তের বিশেষ দিন হলেও, বাঙালির ঘরে পার্বণ হয় এই সময়ে। পৌষ মাস আগলে রাখার মাস। নতুন ধান ঘরে তুলে পরিবারের সমৃদ্ধি কামনা করার জন্যই বোধহয় পৌষের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

‘আউনি বাউনি কোথাও না যেও, তিন দিন ঘরে বসে পিঠেপুলি খেও’— গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে একসময় মকর সংক্রান্তি উদযাপন শুরু হতো এই সুরেই। নতুন ধানের শিস বা খড় বিনুনির মতো করে সংক্রান্তির আগের রাতে বা সে দিন ঘরের আসবাবে বেঁধে উলু, শঙ্খধ্বনির মাধ্যমে শুরু হত উদযাপন। তুলসী মন্দিরে আঁকা হত নেড়া-নেড়ির ছবি। ঢেঁকিতে ছোঁয়ানো হত সিঁদুর। পুজোর আসনের সামনে নতুন চালের গুঁড়ো দিয়ে পিঠের প্রতিরূপ আঁকা হত। খেজুর গুড়, দুধ, চালের গুঁড়ো সহযোগে তৈরি হত নানা স্বাদের পিঠেপুলি। চন্দ্রপুলি, মালপোয়া, পাটিসাপটা, পায়েস, আরও কত কী! পিঠের নানা আকার গড়তে গড়তে সকাল থেকে সন্ধ্যে হত উনুনের ধারে বসে থাকা বাড়ির রন্ধন পটিয়সী রমণীর। মাটির সরায় নিপুণ হাতে পিঠে তৈরি ছিল কঠিন কাজ।

দিন বদলেছে। নতুন প্রজন্মের হাত ধরে যেমন কাগজ-কলম এ যুগে কার্যত অচল, প্রায় তেমনই পুডিং, ডোনাটের নেশায় পিঠেপুলিও কোণঠাসা। পছন্দের ‘ডিজার্ট’ বলতে আমরা বিলিতি মিষ্টিই বেছে নিচ্ছি আজকাল। গ্রামগঞ্জে কিছু লোক-উপাচারকে মান্যতা দেওয়া হলেও শহরে সে সবের চল আজ আর প্রায় নেই বললেই চলে। সামাজিক চাহিদায় প্রতি বাড়িতে যেখানে স্বামী-স্ত্রী উভয়েই সকাল থেকে রাত অর্থ উপার্জনে ব্যস্ত, সেখানে গৃহস্থালি কাজের শ্রমও আগামী প্রজন্মের কাছে বিনা-পারিশ্রমিকযোগ্য থাকবে বলে মনে হয় না।

ভালবেসে পিঠেপুলি তৈরির সময় কোথায়?

অপেক্ষাকৃত অ-লাভজনক ব্যবসায় দিন দিন পিঠেপুলির মাটির ছাঁচ গড়ার মানুষ হারিয়ে যাচ্ছেন। হাতের কাছে নানা ডেলিভারি অ্যাপ থাকায় ঘরে বসেই মিলছে পছন্দের ফাস্ট ফুড। আর কখনও যদি পিঠের স্বাদ নিতে নিতান্তই মন চায়, তবে নানা দোকানে সহজেই মিলছে তা। তবে ভেজালও বড় দায়। যদি বা ভালবেসে বাজার থেকে চালের গুঁড়ো, গুড় কিনে নিয়ে এলেন, তা দিয়ে মনের মতো পিঠে তৈরি হল না। চালের গুঁড়োয় সুজি আর গুড়ে বালি। হিমায়িত নারকেল কোরা, নারকেল দুধ আর যাই বলুন খাঁটির স্বাদ পেতে অপারগ। ও দিকে উষ্ণায়নের দাপটে ক’দিনই বা শীতে তাপমাত্রা নামছে ১০-১২ ডিগ্রিতে। সে কারণে খেজুরের রসের সেই স্বাদ প্রাকৃতিক নিয়মে ক্ষয়িষ্ণু প্রায়।

আজকাল বাউলের পৌষালি পার্বণ ভজনে যেমন সীমাবদ্ধতা এনেছে কালের নিয়ম, তেমনই পৌষ-পার্বণের রীতিও অচিরেই হারিয়ে যাওয়ার পথে। তাতে ভয় ধরছে অনেকেরই। আশঙ্কা একটাই, পৌষ পার্বণ বাঙালির ভবিষ্যতের চর্বিত-চর্বণ না হয়ে দাঁড়ায়।

লেখক: শিক্ষিকা

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Poush Parbon poush

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy