১৯৫২ সালের ক্যানিং পশ্চিম বিধানসভা কেন্দ্রের ভোটার তালিকা খুঁজে পাননি একুশ বছরের তরুণ নিট পরীক্ষার্থী সাবির আলি মণ্ডল। তাই ভরসা ১৯৫৬-র তালিকা। দাদুর বাবা নসরুদ্দিন মণ্ডলের নামটা ওয়েবসাইটে সেই লিস্টে দেখেই তড়িঘড়ি কলকাতার শেক্সপিয়র সরণিতে রাজ্য লেখ্যাগারের (স্টেট আর্কাইভস) দফতরে হাজির হয়েছেন।
সাবিরের বাবা রেজাউল অন্ধ্রপ্রদেশে জরির কাজ করেন। দেশ জুড়ে বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের গায়ে বাংলাদেশি তকমা সেঁটে অকথ্য অত্যাচারের খবরে বাবার জন্য আতঙ্কে ঘুমোতে পারছিলেন না সাবির। আর্কাইভসের দফতরে আবেদন করায় শংসাপত্র প্রস্তুত করতে ওঁরা ৩০ অগস্ট পর্যন্ত সময় দিয়েছেন।
একদা বিষয়সম্পত্তি সংক্রান্ত মামলা ছাড়া সচরাচর পুরনো ভোটার তালিকার নথির কেউই পরোয়া করতেন না। বছর আটেক আগে এনআরসি-জুজু থেকেই বাপ-দাদার মান্ধাতার আমলের নথি গুছিয়ে রাখার হিড়িক পড়ে। রাজ্য উচ্চ শিক্ষা দফতরের অধীনে স্টেট আর্কাইভসের ডিরেক্টরেটে তখন ভিড় সামলাতে পুলিশ বসাতে হয়েছিল। এখন পুরনো নথি অনেকটাই সুবিন্যস্ত। ১৯৭১ পর্যন্ত ভোটার তালিকার বেশির ভাগ নথি প্রকাশ্য ওয়েবসাইটেও রয়েছে। তবু এখনও যা ভিড় হচ্ছে, নেহাতই কম নয়। দফতরের সংশ্লিষ্ট এক কর্তা মঙ্গলবার বললেন, “অন্য সময়ে দশ জন এলে এখন ১০০ জন আসছেন। বিহারে এসআইআর-এর সমীক্ষা শুরু হতে পশ্চিমবঙ্গেও অনেকে সুরক্ষিত থাকতে তিন-চার প্রজন্ম আগের পারিবারিক ভোটার তালিকা খুঁজছেন। ভিন্ রাজ্যে শ্রমিকরা মার খেতে শুরু করায় আতঙ্ক জারি রয়েছে।’’
রাজ্যে লেখ্যাগারে প্রথম সারির আধিকারিক ২৭ জনের মধ্যে বড়জোর ১০ জন আছেন। নিচুতলার কর্মীর সংখ্যায় ঘাটতি ১০০ জনের কাছাকাছি। এই অবস্থায় নথি মিলিয়ে কাউকে শংসাপত্র দিতে মাসখানেক সময় চাইছেন আর্কাইভস কর্তারা। কিন্তু কোচবিহারের মতো দূরের জেলা থেকে আসা অনেকে কলকাতায় ঠাঁইহীন দশায় কার্যত রাস্তায় পড়ে থাকছেন। ফলে অনেককেই সময়ের ঢের আগে শংসাপত্র দিতে তৎপর আর্কাইভস কর্তারা।
একলা মায়ের কাছে বড় হওয়া রাজারহাটের সিরাজুল ইসলাম এসেছেন ১৯৬০-এর ভোটার তালিকায় তাঁর নানা, নানির নামের শংসাপত্রের খোঁজে। কোচবিহারের ৬৭ বছরের বৃদ্ধ আজহার আলি মণ্ডল বলছিলেন, ‘‘আমার জেঠতুতো দাদার একটু বুদ্ধি কম। তাই পুরনো ভোটার লিস্টে জেঠার নামের খোঁজে এসেছি। নতুন লিস্টের সমীক্ষা হলে দাদা তাহলে একটু সহজে বোঝাতে পারবে, ও এখানকারই।’’ সাবিরের মামা আরবির শিক্ষক রাকিব লস্করও এসেছেন কেরলের শ্রমিক নিজের ভাইদের পরিচয় সুনিশ্চিত করতে। পুরনো ভোটার লিস্টে বাবা, কাকাদের নামের শংসাপত্র হাতে থাকলে দুম করে অনাগরিক বা বিদেশি তকমা দেওয়ার হাত থেকে হয়তো রেহাই মিলবে।
এ দিন দুপুরে স্টেট আর্কাইভসের দফতরে জড়ো হওয়া ভিড়টার আলোচনায় ঘুরেফিরেই আসছিল রিজেন্ট পার্কের দিলীপকুমার সাহার নাম। ৫০ বছর আগে বাংলাদেশ থেকে এসে ভোটার তালিকা নিবিড় সংশোধনের আতঙ্কে আত্মঘাতী হওয়ার যন্ত্রণা আতঙ্ক ছড়ায় নথির খোঁজে আসা ভিড়টাতেও। তরুণ সাবির বলছিলেন, ‘‘ভোটার তালিকায় দাদু-নানাদের নাম থেকে তিন-চার প্রজন্ম আগের সব রকমের নথি এখন রেখে দিচ্ছি! অনেকেরই বাড়ির দলিলের মতো পুরনো কাগজ নেই। কখনও এ সব নিয়েও মাথা ঘামাতে হবে আগে ভাবিইনি!’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)