এ দিন, বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ ওই প্রতিনিধি দলের সদস্যদের নিয়ে নবান্নের বেশ কয়েকজন কর্তা এবং কলকাতা পুলিশের জনা কয়েক পদস্থ অফিসার নগর দায়রা আদালতের বিচার ভবন পরিদর্শন করেন।
অস্ত্রবর্ষণ মামলায় অভিযুক্ত কিম ডেভিকে বিচারের জন্য নিয়ে আসার আগে বুধবার ব্যাঙ্কশাল কোর্ট চত্বর ঘুরে দেখে গেলেন ডেনমার্কের আধিকারিকেরা। নিজস্ব চিত্র।
পুরুলিয়া অস্ত্রবর্ষণ মামলায় মূল অভিযুক্ত ডেনমার্কের নাগরিক নিয়েলস্ হোল্ক ওরফে কিম ডেভির প্রত্যর্পণের সম্ভাবনা জোরালো হয়েছে। সাতাশ বছরের পুরনো ওই মামলার কুয়াশা এখনও কাটেনি। ডেভির (যার আসল নাম নিয়েলস্ ক্রিশ্চিয়ান নিয়েলসন) প্রত্যার্পণ নিয়েও দু-দেশের টানাপড়েনের জের ছিল অব্যাহত। গত আড়াই দশকে, ডেভিকে এ দেশে নিয়ে এসে ওই মামলার নিষ্পত্তি ঘটাতে দিল্লি ডেনমার্ক সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার কসুর করেনি। তবে, সে দেশের আইন মন্ত্রক বেঁকে বসায় তা এত দিন ফলপ্রসূ হয়নি। বেশ কিছু শর্ত আরোপ করে এ বার কিম ডেভির প্রত্যার্পণে রাজি হয়েছে ডেনমার্ক।
তারই প্রথম ধাপ, এ দেশের তথা কলকাতার ব্যাঙ্কশাল আদালতের বিচারকক্ষ, স্থানীয় সংশোধনাগারের হালহকিকত খতিয়ে দেখতে বুধবার সরজেমিনে কলকাতা ঘুরে গেলেন ডেনমার্ক পুলিশ ও প্রশাসনের এক প্রতিনিধি দল। এ দিন, বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ ওই প্রতিনিধি দলের সদস্যদের নিয়ে নবান্নের বেশ কয়েকজন কর্তা এবং কলকাতা পুলিশের জনা কয়েক পদস্থ অফিসার নগর দায়রা আদালতের বিচার ভবন পরিদর্শন করেন। নবান্ন সূত্রে জানা গিয়েছে, কলকাতা নগর দায়রা আদালতের মুখ্য বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাস-সহ আদালত চত্বর খুঁটিয়ে দেখে প্রতিনিধি দলের পরামর্শ ‘বিচারাধীন বন্দি’ হিসেবে কিম ডেভিকে সংশোধনাগারের বাইরে কোথাও রাখা হোক। তবে, সে ব্যাপারে এখনই কোনও আশ্বাস প্রতিনিধি দলের সদস্যদের দেওয়া হয়নি। দিল্লি এবং রাজ্য প্রশাসনের আলোচনার পরেই সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানা গিয়েছে। কিমের নিরাপত্তার কারণে হাওড়ার কোনও গ্রামীণ এলাকায় ‘বিশেষ’ পরিকাঠামো গড়া হতে পারে বলেও নবান্ন সূত্রে জানা গিয়েছে।
সাতাশ বছর বয়স হলেও, পুরুলিয়া অস্ত্র বর্ষণ মামলা নিয়ে কৌতূহলে এখনও ধুলো পড়েনি, বরং তা নিয়ে কৌতূহল রয়ে গিয়েছে গোটা রাজ্যের। ১৯৯৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর রাতে, পুরুলিয়ার ঝালদা-মারামু-বেলামু এলাকা জুড়ে ছোট্ট একটি অ্যান্তোনভ-২৬ বিমান থেকে দফায় দফায় ঝরে পড়েছিল স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র বোঝাই বস্তা। যে তালিকায় একে-৪৭ থেকে লাইট মেশিনগান, বাদ ছিল না কিছুই। রহস্যের কিনারা করতে পুলিশ-প্রশাসন যখন হিমসিম খাচ্ছে, সেই সময়ে দিন তিনেকের মধ্যে দেশের আকাশে ফের দেখা মেলে ওই লাটভিয়ান বিমানের। ভারতীয় বায়ুসেনা এ বার তৎপর হয়ে বিমানটিকে মুম্বইয়ে অবতরণ করতে বাধ্য করে। আটক করা হয় বিমানে সওয়ার ব্রিটিশ নাগরিক পিটার ব্লিচ এবং ৫ লাটভিয়ান নাগরিককে। প্রায় আড়াই বছর ধরে মামলা চলার পরে আদালত তাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। তবে, সেই সময়ে পিটার দাবি করেছিলেন— একটি ধর্মীয় সংগঠনের সদস্য কিম ডেভি ওই অস্ত্র বর্ষণের মূল মাথা। ওই সংগঠনের ঘনিষ্ঠ সমর্থক হিসেবে বিদেশ থেকে অস্ত্র কিনে পুরুলিয়ায় ওই সংগঠনের সদর দফতরে পৌঁছে দেওয়ার বরাত কিম ডেভিই দিয়েছিলেন। এর পিছনে রাজ্য জুড়ে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টাও ছিল। তবে ইন্টারপোল ‘লুক আউট’ নোটিস জারি করলেও কিম ডেভির খোঁজ মেলেনি। ফলে অস্ত্র বর্ষণের প্রকৃত কারণ ধোঁয়াশায় রয়ে গিয়েছিল। আর, সেই সূত্র ধরে, লাটভিয়া এবং ব্রিটিশ সরকারের ক্রমাগত চাপে শেষতক, ২০০৪ সালে পিটার এবং অন্য ধৃতদের মুক্তি দিতেও বাধ্য হয় দিল্লি। এর তিন বছর পরে, ২০০৭ সালে আচমকাই কিম ডেভির খোঁজ মেলে। কিন্তু, তাকে প্রত্যাপর্ণের প্রশ্নে রাজি হয়নি ডেনমার্ক। ২০১১ সালে ডেনমার্ক থেকেই কিম দাবি করে, এ দেশের এক গোয়েন্দা সংস্থার নির্দেশেই পুরুলিয়ায় ওই অস্ত্র বর্ষণের ছক কষা হয়েছিল। রহস্যের অভিমুখ ঘুরে গেলেও কিম ডেভিকে এ দেশে ফিরিয়ে এনে মামলার বিচার শুরু করা যায়নি। ২৭ বছর পরে, সেই সম্ভাবনাই ফের উস্কে দিয়েছে ডেনমার্ক সরকার। তবে তা ঝুলে রয়েছে সে দেশের প্রতিনিধি দলের রিপোর্টের সুতোর উপরে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy