Advertisement
E-Paper

টক্কর দিয়ে দ্বিতীয় বিজেপি

কয়েক মাস আগেও এ জেলায় এলাকা দখল এবং পুনর্দখল ঘিরে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল রক্তপাতের রাজনীতি! বীরভূমের পাড়ুই-ই ক্রমশ যেন হয়ে উঠছিল বিজেপি-র নন্দীগ্রাম। এই ‘পাড়ুই-লাইন’-এর উপরে ভর করেই রাজ্য রাজনীতিতে নিজেদের প্রাসঙ্গিক করে তোলার মরিয়া চেষ্টা শুরু বিজেপি-র। আর তৃণমূলের দাপুটে জেলা সভাপতি কেষ্ট মণ্ডলের সঙ্গে টক্কর দিয়ে সেই জেলাতেই অপ্রত্যাশিত ফল করল গেরুয়া শিবির!

রোহন ইসলাম

শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০১৫ ০১:১২
জয়ের নিশান। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম।

জয়ের নিশান। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম।

কয়েক মাস আগেও এ জেলায় এলাকা দখল এবং পুনর্দখল ঘিরে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল রক্তপাতের রাজনীতি! বীরভূমের পাড়ুই-ই ক্রমশ যেন হয়ে উঠছিল বিজেপি-র নন্দীগ্রাম। এই ‘পাড়ুই-লাইন’-এর উপরে ভর করেই রাজ্য রাজনীতিতে নিজেদের প্রাসঙ্গিক করে তোলার মরিয়া চেষ্টা শুরু বিজেপি-র। আর তৃণমূলের দাপুটে জেলা সভাপতি কেষ্ট মণ্ডলের সঙ্গে টক্কর দিয়ে সেই জেলাতেই অপ্রত্যাশিত ফল করল গেরুয়া শিবির!

মঙ্গলবার ফল প্রকাশের পরে দেখা যাচ্ছে, বীরভূমে চারটি পুরসভায় বিজেপি-র স্কোর ১-১-৩-৪ (সিউড়ি, বোলপুর, সাঁইথিয়া ও রামপুরহাট)। গত বারের তিন গুণ বেশি আসন পেয়েছে তারা। অনুব্রতর খাসতালুকে এই প্রথম আসন ছিনিয়ে নিয়েছে। দখল করেছে মন্ত্রী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওয়ার্ডও। অথচ ভোটের ঠিক আগেই দলের অন্দরে টিকিট পাওয়া নিয়ে ক্ষোভ চরমে উঠেছিল। সিউড়িতে দলের এক পর্যবেক্ষককে ধাক্কাধাক্কি করা হয়েছিল। মাথাচাড়া দিয়েছিল একাধিক গোষ্ঠী। কফিনে শেষ পেরেক ছিল দুম করে জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডলের পদ থেকে সরে দাঁড়ানো। সব দিক থেকে কোণঠাসা হওয়ার পরেও বীরভূমে দলের এই ফলাফলে নৈতিক জয় হয়েছে বলেই দাবি করছেন বিজেপি রাজ্য নেতৃত্ব।

ফল ঘোষণার পরে এ দিন বিজেপি রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলছেন, “পাড়ুইয়ে গরিব সংখ্যালঘু ভাই-বোনেদের উপরে দিনের পর দিন অত্যাচার চালিয়েছে অনুব্রতর লোকেরা। তাঁদের বাঁচা-মরার অধিকারটুকুও কেড়ে নিয়েছে। ঠিক যে ভাবে এ বারের পুরভোটে শাসকদল সন্ত্রাস চালিয়ে অবাধ ভোট করতে দেয়নি। ভোটারদের ভোট দেওয়ার স্বাধীনতাও ছিনিয়ে নিয়েছে। তার পরেও এই ফলে আমাদেরই নৈতিক জয় হয়েছে। অনুব্রতর খাসতালুক থেকেও আসন ছিনিয়ে নিতে পেরেছি।’’ তাঁর দাবি, অবাধ ভোট হলে বীরভূমে বিজেপি-র ফল আরও ভাল হতো।

যদিও দু’একটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া জেলায় পুরভোট নিয়ে বিরোধীরা তেমন কোনও অভিযোগ তোলেননি। বরং ভোটের পরে অনেক বিরোধী নেতা-ই মোটের উপর পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকার প্রশংসা করেছিলেন। তার পরে বিজেপি রাজ্য সভাপতির এই যুক্তি ধোপে টেকে না বলেই দাবি তৃণমূলের। অনুব্রতর দাবি, ‘‘লোকসভা ভোটে ইউপিএ সরকারের প্রতি প্রবল ক্ষোভ ছিল। তার জন্যই বিজেপি ফল কিছুটা ভাল হয়েছিল। সন্ত্রাস হলে ওরা একটা আসনও পেত না।’’

ঘটনা হল, গত লোকসভা ভোটের নিরিখে সিউড়িতে ১৬টি ওয়ার্ডে এগিয়েছিল বিজেপি। সেখানে মাত্র একটি ওয়ার্ডই জিততে পেরেছে বিজেপি। আবার বোলপুরে ৭টিতে এগিয়ে থাকলেও জয় এসেছে মাত্র একটি ওয়ার্ডে। একই ভাবে সাঁইথিয়া ও রামপুরহাটে দল যথাক্রমে ১৮ ও ১৬টি ওয়ার্ডে এগিয়ে ছিল বিজেপি। কিন্তু, এ দিনের ফলে দেখা যাচ্ছে বোলপুরে একটি ও রামপুরহাটে চারটি ওয়ার্ড বিজেপি দখলে আনতে পেরেছে। এই হিসাব দেখিয়েই বিজেপি-র এই ফলকে কোনও গুরুত্ব দিতেই নারাজ শাসকদল। যদিও দুধকুমারবাবু বলছেন, ‘‘লোকসভা এবং পুরসভা ভোটের মধ্যে আকাশ-জমিন ফারাক রয়েছে।’’ লোকসভার ফলের হিসাব দেখিয়ে বিজেপি-র সাফল্যকে খাটো করা ঠিক নয় বলেই জেলা বিজেপি নেতৃত্বের মত।

কেন? ব্যাখ্যা দিচ্ছেন দলের জেলা আহ্বায়ক অর্জুন সাহা। তাঁর যুক্তি, গত পুরভোটে রামপুরহাটে ২ এবং সাঁইথিয়ায় একটি ছাড়া বিজেপি-র কোনও আসন ছিল না। এজেন্ট তো দূর অস্ত, পুরসভাগুলির সমস্ত আসনে প্রার্থীও দেওয়া যায়নি। এ বারে ৭৩টি ওয়ার্ডেই দল প্রার্থী দিতে পেরেছে। সেই নিরিখে দল এ বার সিউড়ি ও বোলপুরে শুধু খাতাই খোলেনি, অন্য দুই পুরসভাতে আসন সংখ্যাও বাড়াতে সফল হয়েছে। অর্জুনবাবুর দাবি, ‘‘পুরভোটে তৃণমূল এই জেলায় নীরব সন্ত্রাস চালিয়েছে। মানুষকে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে বাধা দিয়েছে। রামপুরহাটে তো ছাপ্পাও পড়েছে। তার পরেও সীমিত ক্ষমতার মধ্যেও আমরা দেখিয়ে দিয়েছি, বিজেপি কী করতে পারে!’’ তবে, বিজেপি নেতৃত্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই মেনে নিচ্ছেন, পুরভোটের মুখে দুধকুমার পদত্যাগ না করলে দলের ফল আরও ভাল হতো।

বস্তুত, গত পঞ্চায়ত ভোটেও বীরভূমে অনুব্রতকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস দেখায়নি তাঁর কোনও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। সেই অপ্রতিরোধ্য কেষ্ট-বাহিনীর সঙ্গে সমানে টক্কর দিয়ে দুধকুমারই হয়ে উঠেছিলেন জেলায় বিরোধীদের প্রধান মুখ। কিন্তু পুরভোটের ঠিক আগেই নেতৃত্বের বিরুদ্ধে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে মদত দেওয়ার অভিযোগ তুলে পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দেন দুধকুমার। জেলায় দুধকুমার ঘনিষ্ঠ বোলপুরের এক নেতার কথায়, “দল যতটুকু মুখ তুলতে পেরেছিল, আশা জাগিয়েছিল, দুধদার ইস্তফা তাতে একটা বড় ধাক্কা। নিচুতলার যে সব কর্মী এত দিন তৃণমূলের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে লড়ছিলেন, তাঁরা এই ঘটনায় অনেকটাই দমে গেলেন।”

এ নিয়ে ক্ষোভ থেকে গিয়েছে দলের নিচুতলাতেও। সাঁইথিয়ায় দলের এক তরুণ কর্মীর আক্ষেপ, “গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দুধকুমারদার (প্রাক্তন জেলা সভাপতি) সঙ্গে আমরা গুটি কয়েক জন বাড়ি বাড়ি ঘুরেছি। মাত্র ৭-৮ জনকে নিয়েই তৃণমূলের শাসানির মাঝে মোড়ে মোড়ে পথসভা করেছি। অথচ যে দিন এখানে রূপাদি (গঙ্গোপাধ্যায়) রোড-শো করলেন, সেই কর্মসূচির কথা ভোটের দায়িত্বে থাকা দুধকুমার মণ্ডলই জানতেন না! তা নিয়ে নেতাদের মধ্যে বিতণ্ডাও শুরু হয়ে গেল। এমনটা হলে দলের নিচুতলায় কী বার্তা পৌঁছয় বলুন তো!”

উল্টো দিকে, ভোটের আগে দেওয়া হিসাব প্রায় অক্ষরে অক্ষরে মিলিয়ে দিয়ে পুরসভাগুলির সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন নিজের দখলে এনে বিধানসভা ভোটের আগে যেন বাড়তি ‘অক্সিজেন’ টেনে নিলেন দিদির ‘দক্ষ সংগঠক’ অনুব্রত মণ্ডল। ফোনে দলীয় কর্মীর উচ্ছ্বাসের মধ্যেই বললেন, “বিজেপি আগে পাড়া ক্রিকেটটা ভাল করে শিখে আসুক। দশ ওভার টিকে থাকার মুরোদ নেই। ওয়ান-ডে খেলতে নেমেছিল!”

বামেরা মুছে গিয়েছে। কংগ্রেসও পিছিয়ে। এই ভোটের ফলকে তাই প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিজেপি-র উত্থানেই শিলমোহর পড়ল বলে মনে করছেন রাজনৈতিক মহল। কিন্তু, তার পরেও প্রশ্ন উঠছে পাড়ুই-পরবর্তী বীরভূমে বিজেপি লোকসভা ভোটের ফলের ধারে কাছেও কেন জেতে পারল না? তাঁর ঘনিষ্ঠেরা এর জন্য রাজ্য নেতৃত্বকে দুষলেও মুখ খুলতে নারাজ দুধকুমার। ফোনে শুধু বললেন, “এ নিয়ে আমার কোনও মন্তব্য করা ঠিক হবে না।”

(সহ-প্রতিবেদন: অর্ঘ্য ঘোষ ও দয়াল সেনগুপ্ত)

birbhum bjp suri bjp bjp second position rampurhat bjp rampurhat vote result bolpur bjp rohan islam
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy