বিপুল খেলাপি ঋণ মেটানোর ৪০ শতাংশ টাকা চার মাস আগেই পাঠিয়ে দিয়েছে কেন্দ্র সরকার। ১০ শতাংশ টাকা দিয়ে দিয়েছে নাবার্ড-ও। তার পরেও জট কাটিয়ে তালা খোলেনি বীরভূম কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের একটি শাখাতেও!
আর তার জন্য রাজ্য সরকারের ঢিলেঢালা মনোভাবকেই দুষছেন ওই ব্যাঙ্কের উপর নির্ভরশীল নানা মহল। যদিও রাজ্য সরকার প্রয়োজনীয় ৫০ শতাংশ টাকা মিটিয়ে ব্যাঙ্ক চালু করার ব্যাপারে যথেষ্টই তৎপর বলে দাবি করছেন ব্যাঙ্কের বর্তমান চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম। জানানো হয়েছে, ব্যাঙ্কগুলির অডিটের কাজ চলছে। শুধু মাত্র রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ছাড়পত্র মেলাই বাকি। তার পরেই খুলে যাবে প্রায় এক বছর ধরে বন্ধ থাকা ব্যাঙ্কের সমস্ত শাখা। চেয়ারম্যান দাবি করছেন, ‘‘কয়েকটা দিন ধৈর্য ধরুন। ব্যাঙ্ক খুলল বলে।’’ কিন্তু, সেই দিনটি ঠিক কবে আসবে, শুধু তার-ই উত্তর মিলছে না। অথচ ব্যাঙ্ক খোলার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হওয়ার পর আবেগ আর ধরে রাখতে পারছেন না ব্যাঙ্ক কর্মী, গ্রাহক, সমবায় কৃষি উন্নয়ন সমিতি ও সেগুলির কর্মী, আমানতকারী, অসংখ্য চাষি, স্বল্প সঞ্চয় এজেন্ট— সকলেই। তাঁদেরই একটা অংশের ক্ষোভ, ‘‘চেয়ারম্যান ব্যাঙ্কের লাইসেন্স বাতিল হওয়ার সময়ও একই কথা বলেছিলেন। মাঝে গত এক বছরে ওঁর মুখ থেকে একই আশ্বাসবাণী শুনে আসছি। কিন্তু, কোনও ফল তো দেখতে পাচ্ছি না!’’
প্রসঙ্গত, প্রায় ৬২ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হয়ে যাওয়ায় ২০০৭ সালে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ‘ব্যাঙ্কিং রেগুলেশন অ্যাক্ট ১১/১’ আরোপ করে ব্যাঙ্কের সব ক’টি শাখায় ঋণদানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নিয়ম হল, কোনও ঋণ তথা অনুৎপাদক সম্পদের (এনপিএ) পরিমাণ ৫ শতাংশের বেশি হওয়া চলবে না। কিন্তু, বীরভূম জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক যে পরিমাণ ঋণ দিয়েছিল, তার ৫২ শতাংশই খেলাপি বা অনুৎপাদক সম্পদে পরিণত হয়। পথ ছিল একটাই। রাজ্য সরকার ব্যাঙ্ক বাঁচাতে তখন যদি সেই পরিমাণ টাকা দিয়ে দিত। কিন্তু তেমন কোনও উদ্যোগ না নেওয়ায় চরম পদক্ষেপ নেয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। লাইসেন্স বাতিল হয়ে তালা ঝুলে যায় ১৭টি শাখাতেই। তার পর থেকেই ব্যাঙ্ক চালুর দাবিতে আন্দোলন থেকে মামলা, সবই হয়েছে।
প্রশাসন সূত্রের খবর, প্রায় বন্ধের দোরগোড়ায় থাকা এবং লাইসেন্স বাতিল হওয়া দেশের ২৩টি সমবায় ব্যাঙ্ক বাঁচাতে উদ্যোগী হয়েছে কেন্দ্র সরকার। উত্তরপ্রদেশের ১৬টি, জম্মু ও কাশ্মীরের ৩টি, মহারাষ্ট্রের ৩টি ব্যাঙ্কের সঙ্গে তালিকায় রয়েছে এ রাজ্যের ‘বীরভূম কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক’-ও। ব্যাঙ্কগুলিকে বাঁচাতে প্রয়োজন মোট ২,৩৭৩ কোটি ৪২ লক্ষ টাকা। কেন্দ্র সরকার তার মধ্যে ৬৭৩ কোটি ২৯ লক্ষ টাকা দেবে বলে বরাদ্দ করেছে। ঠিক হয়, গত ৩১ মার্চের মধ্যেই রাজ্য সরকারগুলি দেবে ১,৪৬৪ কোটি ৫৯ লক্ষ টাকা এবং নাবার্ড দেবে ২৩৭ কোটি টাকা। বীরভূম জেলা সমবায় ব্যাঙ্ক বাঁচাতে কেন্দ্র সরকার তাদের ধার্য ৩১ কোটি ২০ লক্ষ টাকা ইতিমধ্যেই পাঠিয়ে দিয়েছে। নাবার্ডের ৭ কোটি ৮০ লক্ষ টাকাও চলে এসেছে। কিন্তু, রাজ্য সরকার নির্ধারিত ৩৯ কোটি টাকা মার্চের মধ্যে জমা দিয়েছে কিনা, তা নিয়েই সকলে সংশয়ে। ওই টাকা জমা পড়লে ব্যাঙ্ক খোলার বিষয়টি অনেকটাই স্পষ্ট হবে বলে মনে করছে, এ নিয়ে আন্দলনরত ‘সমবায় বাঁচাও মঞ্চ’। তবে, মঞ্চের আহ্বায়ক সাধন ঘোষের অভিযোগ, ‘‘রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পরবর্তী পদক্ষেপ কী কী হতে চলেছে, সেই সম্পর্কে ব্যাঙ্কের কর্তাব্যক্তি থেকে রাজ্য সরকার— সবাই ওয়াকিবহল ছিলেন। তার পরেও ব্যাঙ্কের লাইসেন্স বাতিল হওয়ার আগে কেউ পরিস্থিতির মোকাবিলায় সতর্ক হননি। প্রতিটি শাখায় তালা ঝোলার পরেও যতটা দরকার ছিল, ততটা তৎপর হননি। এখনও সেই একই গাছাড়া মনোভাবই দেখতে পাচ্ছি। কেন্দ্র সরকার ও নাবার্ড টাকা পাঠানোর চার মাস পরেও তা হলে কেন ব্যাঙ্ক খোলা গেল না!’’
যদিও সমবায় দফতর সূত্রের খবর, রাজ্য সরকারের বরাদ্দ টাকা রাজ্য সমবায় ব্যাঙ্কে জমা পড়েছে। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি এ নিয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটিও গঠিত হয়েছে। সেখানে ব্যাঙ্কের সিইও, চেয়ারম্যান, সমবায় দফতরের আধিকারিক ছাড়াও জেলাশাসক, পুলিশ সুপার, নাবার্ড ও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রতিনিধি, জেলার সভাধিপতির মতো ব্যক্তিরা রয়েছেন। ওই বৈঠকেই ঠিক হয়েছিল, ব্যাঙ্কের প্রতিটি শাখার অডিট করা হবে। সে কাজ শুরুও হয়েছে। তা হলে আর কীসের অপেক্ষা? ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান বলছেন, ‘‘পুরভোট চলে আসায় একটু দেরি হচ্ছে।’’ আবার এ-ও শোনা যাচ্ছে, বিষয়টি হাইকোর্টে বিচারাধীন। চূড়ান্ত রায়ের অপেক্ষা করছে সরকার। তবে, বিষয়টি এখনই স্পষ্ট করতে নারাজ রাজ্যের সমবায় মন্ত্রী জ্যোতির্ময় কর। ব্যাঙ্ক কবে খুলবে জিজ্ঞাসা করা হলে, তিনি বলেন, ‘‘পুরভোটের জন্য এখন নির্বাচন বিধি জারি রয়েছে। এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না।’’
তবে, রাজ্য প্রশাসনেরই এক কর্তা দাবি করছেন, বীরভূম কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক খোলার ব্যাপারে রাজ্য সরকার প্রথম থেকেই তৎপর। ওই ব্যাঙ্ককে ঘিরে বীরভূমে কয়েক লক্ষ মানুষের তৈরি হওয়া অনিশ্চয়তা সরকারকেও উদ্বেগে ফেলেছে। তাই ব্যাঙ্ক খুলতে সব রকমের পদক্ষেপই সরকার করছে। তাঁর দাবি, দুশ্চিন্তা দূর করে ব্যাঙ্ক খুলতে চলেছে খুব শীঘ্রই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy