Advertisement
E-Paper

প্রকল্পে দুর্নীতি, ক্ষোভ ছড়াচ্ছে ময়ূরেশ্বরে

প্রশাসন কিংবা কোনও তদন্তকারী সংস্থা নয়, ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ এ বার প্রকাশ্যে এনে দিল স্রেফ একটি রটনা!

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০১৬ ০২:২৪
১০০ দিনের টাকা না পাওয়ায় পুলিশকে ঘিরে ধরে বিক্ষোভ গ্রামবাসীর। ছবি:  অনির্বাণ সেন।

১০০ দিনের টাকা না পাওয়ায় পুলিশকে ঘিরে ধরে বিক্ষোভ গ্রামবাসীর। ছবি: অনির্বাণ সেন।

প্রশাসন কিংবা কোনও তদন্তকারী সংস্থা নয়, ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ এ বার প্রকাশ্যে এনে দিল স্রেফ একটি রটনা!

সে অভিযোগ ঘিরেই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে ময়ূরেশ্বরের গ্রামে গ্রামে। কেন্দ্রীয় ওই প্রকল্পে নিযুক্ত সুপার ভাইজারদের বাড়িতে চড়াও হয় উত্তেজিত জনতা। এ দিন তাঁদের মারধরের পর ৭ দিনের মধ্যে টাকা ফেরতের মুচলেকাও লিখিয়ে নেন বিক্ষোভকারীরা। ময়ূরেশ্বর এলাকার ষাটপলশা পঞ্চায়েতের ঘটনা।

১০০ দিন কাজের প্রকল্প ঘিরে দুর্নীতির অভিযোগ অবশ্য এই প্রথম নয়। দীর্ঘদিন ধরেই ওই পঞ্চায়েতে মজুরদের জবকার্ড এবং পাশবই আটকে রেখে মর্জিমাফিক টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয় বলে অভিযোগ। কিন্তু মজুররা তা জানতেও পারেন না। নিয়মানুযায়ী, ১০০ দিন কাজের প্রকল্পে কর্মদিবস অনুযায়ী বেতনের টাকা সরাসরি মজুরদের ব্যাঙ্কের পাশ বইয়ে জমা হওয়ার কথা। কিন্তু ওই পঞ্চায়েত এলাকায় সেই রেওয়াজ নেই বললেই চলে। পরিবর্তে প্রকল্পের সুপারভাইজাররাই একত্রে সেই টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে মজুরদের বিলি করে থাকেন বলে অভিযোগ। সে জন্য মজুরদের জবকার্ড এবং পাশবইয়ের প্রয়োজনই হয়নি।

পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে ওঠে একটি রটনার পর। সম্প্রতি ওই এলাকায় রটে যায় কেন্দ্রীয় সরকার নাকি প্রতিটি জবকার্ডধারীর পাশ বইয়ে ভাতা বাবদ ১০ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে। সেই টাকা তোলার জন্যই এরপর মজুরেরা এলাকার সুপারভাইজারদের কাছে পাশবই এবং জবকার্ড ফেরত চান।

দুর্নীতি প্রকাশ্যে আসার আশঙ্কায় প্রথমদিকে ওইসব সুপার ভাইজাররা তা ফেরত দিতে চাননি বলে অভিযোগ। ক্ষুব্ধ মজুরেরা তাই বুধবার থেকেই পঞ্চায়েত এবং তৃণমূলের অঞ্চলিক কার্যালয়ে রাত পর্যন্ত বিক্ষোভ দেখান। বাধ্য হয়ে সুপার ভাইজাররা জবকার্ড এবং পাশবই ফেরাতে শুরু করেছেন। তা হাতে পাওয়ার পরই এ দিন কার্যত গ্রামে গ্রামে গণবিক্ষোভ শুরু।

দেখা যায়, মজুরদের অন্ধকারে রেখে প্রায় প্রতিটি পাশবই থেকেই হাজার হাজার টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে!

ঘটনার জানাজানি হওয়ার পর এ দিন সকাল থেকেই এলাকার মজুররা বিভিন্ন সুপারভাইজারের বাড়ি চড়াও হন। পঞ্চায়েত এবং ব্যাঙ্কেও জড়ো হন তাঁরা। বেলা ১২টা নাগাদ গিয়ে দেখা গেল পঞ্চায়েত এবং লাগোয়া ব্যাঙ্কে তখন হাজার খানেক জনতা। তাঁদের সই কিংবা টিপছাপ ছাড়া কি করে দিনের পর দিন টাকা উঠে গেল সেই জবাবদিহি চেয়ে একসময় ক্ষুব্ধ জবকার্ডধারীরা ব্যাঙ্ক ম্যানেজার বাবলু দত্তকেও টানা হ্যাচড়া শুরু করেন। খবর পেয়ে পুলিশ পৌঁছোতেই গাড়ি ঘিরেও বিক্ষোভ শুরু হয়। একসময় পুলিশি আশ্বাসে জনতা পঞ্চায়েত এবং ব্যাঙ্ক থেকে সরে গেলেও তার আঁচ পড়ে বিভিন্ন গ্রামে।

স্থানীয় গোডাউন মাঝিপাড়ায় ছোটডিবুর গ্রামের সুপারভাইজার প্রভাত মণ্ডল এবং তার একসঙ্গী স্বপন দাসকে মারধোর করেন ক্ষুব্ধ বাসিন্দারা। একই দৃশ্য দেখা গেল কাঞ্চনা গ্রামেও। স্থানীয় তিন সুপারভাইজার গৌতম রুজ, অভিজিত মণ্ডল এবং অজিত ভল্লাকে গ্রামের শিবতলায় আটকে রেখে টাকা ফেরতের দাবিতে কার্যত মারমুখী হয়ে ওঠেন জবকার্ডধারীরা। শেষ পর্যন্ত ৭ দিনের মধ্যে প্রাপ্য টাকা ফেরতের মুচলেকা দেওয়ার পর রেহাই মেলে তাঁদের।

মুচলেকা পত্রে স্বাক্ষী হিসাবে স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্যা মীরা দাসের সইও করিয়ে নেন তাঁরা। মীরাদেবী অবশ্য জানিয়েছেন, আমি ওই টাকার ব্যাপারে কিছু জানি না। তবে মুচলেকা পত্রে সুপারভাইজাররা সই করেছেন তার স্বাক্ষী হিসাবেই আমি সই করেছি। ওই গ্রামের বাসিন্দা মিহির ভল্লা, গৌতম দাস, সেরুনিয়ার সন্তোষ ভল্লারা জানান, বহুবার সুপারভাইজারদের কাছে জরকার্ড এবং পাসবই ফেরত চেয়ে শুনতে হয়েছে ওসব নিয়ে কি হবে, বাড়ি বসেই তো বেতনের টাকা পেয়ে যাচ্ছ। তখন তো ভাবিনি আমাদের পাশবইয়ে ওরা পুকুর চুরি করবে। ভাতার গুজবটা না রটলে তো আমরা কোনদিন বই ফেরতই চাইতাম না।

সুপারভাইজাররা জানিয়েছেন, ‘‘বেআইনি জেনেও জবকার্ডধারীদের সুবিধার জন্যই আমরা জবকার্ড এবং পাশবই স্থানীয় মনোহরপুরের সুরথ মণ্ডলকে জমা দিয়েছিলাম। সুরথই ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে এনে দিত। সেইমতো মজুরদের বিলি করতাম।’’

প্রশ্ন উঠছে কে এই সুরথ মণ্ডল?

স্থানীয় বাসিন্দা তথা জেলা পরিষদের খাদ্য কর্মাধক্ষ্য জটিল মণ্ডলের ডান হাত হিসাবে পরিচিত সুরথ ওরফে বাপ্পা অবশ্য সমস্ত দায় ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বলছেন, ‘‘আমি কোনওভাবেই ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নই। আসলে সুপারভাইজাররা নিজেরা বাঁচতে আমার নাম জড়িয়েছে।’’

স্থানীয় বাসিন্দারা অবশ্য জানিয়েছেন, ব্যাঙ্ক, পঞ্চায়েত এমনকী ব্লকে সুরথবাবুর সখ্যতা চোখে পড়ার মতো। সেই সুবাদে তিনি সর্বত্র যোগসাজশ করে দীর্ঘদিন ধরেই ওই কারবার চালিয়ে যাচ্ছেন। ব্যাঙ্ক ম্যানেজার বাবলু দত্ত অবশ্য যোগসাজসের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। জানান, ‘‘মজুররাই সই করে টাকা নিয়ে গিয়েছেন। দুর্নীতির অভিযোগ ঠিক নয়।’’

পঞ্চায়েত এবং স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ষাটপলশা পঞ্চায়েত এলাকায় জটিল মণ্ডলই একমাত্র এবং শেষ কথা। ওই পঞ্চায়েত ২০১৫-১৬ আর্থিক বছরে ১০০ দিনের প্রকল্পে ব্লকের ৭ টি পঞ্চায়েতের মধ্যে প্রথম স্থান দখল করে। ওই বছর প্রায় ৪ লক্ষ ৩৯ হাজার ৪৬৪ টি শ্রমদিবসের জন্য ব্যয় হয় প্রায় ৪ কোটি টাকা। কাগজে কলমে ওই কাজ মজুরদের দিয়েই করানো হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ওই কাজ করেছে যন্ত্র। আসলে পঞ্চায়েত এলাকার অধিকাংশ জবকার্ডই সুরথ মণ্ডল ওরফে বাপ্পার কাছে আটক করা রয়েছে বলে অভিযোগ। মজুরদের কাছ থেকে টাকা তোলার ফর্মেও সইও করিয়ে রাখা হয়। সেক্ষেত্রে মজুররা কাজ না করেও চুক্তি মাফিক যৎসামান্য কিছু টাকা পান। ওই তৃণমূল কর্মীর স্থানীয় ব্যাঙ্কের সঙ্গেও সুসম্পর্ক রয়েছে। সেই সুবাদে তিনি সেই টাকা তুলে যন্ত্র দিয়ে কাজ করান। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, আসলে জটিলবাবুর একাধিক ট্রাক্টর, মাটি কাটার যন্ত্র রয়েছে। যন্ত্রগুলিকে কাজে লাগানোর জন্যই ওই উপায় অবলম্বন করা হয়। আর মজুরদের কাজ যন্ত্র দিয়ে করিয়ে প্রকল্পের একটা বড় অংশ আত্মসাতেরও সুযোগ ঘটে।

স্থানীয় দায়িত্ব প্রাপ্ত জেলা সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য অরূপ বাগ বলেন, ‘‘ওই পঞ্চায়েতে ১০০ দিনের কাজে পুকুরচুরি হয়। আমরা বারবার প্রশাসনকে তা জানিয়েছি। কিন্তু কোনও কাজ হয়নি।’’ এ দিন বারবার সুরথবাবুর মোবাইলে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। অভিযোগ অস্বীকার করেছেন জটিলবাবুও। তিনি বলেন, ‘‘সব বিরোধীদের অপপ্রচার। পঞ্চায়েত কিংবা দলের কার্যালয়ে কোনও বিক্ষোভই হয়নি।’’

অভিযোগ উড়িয়ে উড়িয়ে দেন পঞ্চায়েত প্রধান নন্দদুলাল দাস। বিডিও সৈয়দ মাসুদুর রহমান বলেন, ‘‘লিখিত অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেব।’’

Mayureswar corruption 100 days work
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy