Advertisement
E-Paper

ফের ডাইনি অপবাদ বৃদ্ধা-সহ ৩ জনকে বেঁধে চলল মার

কুলটাঁড় গ্রামের কলেজ পড়ুয়া এক তরুণীর হঠাৎ করে চেহারা ভাঙতে শুরু করেছে। ওই তরুণীর বাবার দাবি, ‘‘মেয়ের কী হয়েছে, বুঝতে পারছি না।বারি ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে কবিরাজ দেখিয়েও কাজ হয়নি।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০১৭ ০৬:২০
বৈঠক: গ্রামে সাঁওতাল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে পুলিশ। —নিজস্ব চিত্র।

বৈঠক: গ্রামে সাঁওতাল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে পুলিশ। —নিজস্ব চিত্র।

ডাইনি অপবাদ দিয়ে জরিমানা আদায় করতে স্থানীয়েরা চড়াও হতেই বাড়ি ছেড়ে পালান বিধবা। কিন্তু রক্ষা পেলেন না তাঁর পরিবার। উন্মত্ত জনতা ওই বিধবার বৃদ্ধা মা ও দুই দাদাকে রাতভর বাড়িতে বেঁধে রেখে মারধরও করেন বলে অভিযোগ। রাতে পুলিশ পৌঁছলেও রোষের আঁচ পেয়ে সারা রাত বাইরে দাঁড়িয়ে থাকল। পুরুলিয়ার বোরো থানার কুলটাঁড় গ্রামে বৃহস্পতিবার রাতের ঘটনা। শুক্রবার সকালে আদিবাসীদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃত্ব গ্রামবাসীকে বোঝানোর পরে বাঁধন খোলা হয় তিন জনের।

ডাইনি অপবাদ দিয়ে নির্যাতন পুরুলিয়ায় নতুন নয়। মাসখানেক আগেই আদ্রার গোঁসাইডাঙায় একটি শিশুর মৃত্যুর পরে তার দুই বয়স্ক আত্মীয়াকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে পরিজনেরা মারধর করে। সম্প্রতি বরাবাজারের সিন্দরি বাজারে সর্পদষ্ট এক বধূকে ওঝার কাছে ঝাঁড়ফুক করাতে গিয়ে সময় নষ্ট করায় তাঁর মৃত্যু হয় বলে অভিযোগ। তারপর বোরোর কুলটাঁড়ের ঘটনা দেখিয়ে দিল, কুসংস্কার এখনও পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে কী ভাবে গেঁড়ে বসে রয়েছে।

কুলটাঁড় গ্রামের কলেজ পড়ুয়া এক তরুণীর হঠাৎ করে চেহারা ভাঙতে শুরু করেছে। ওই তরুণীর বাবার দাবি, ‘‘মেয়ের কী হয়েছে, বুঝতে পারছি না। বারি ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে কবিরাজ দেখিয়েও কাজ হয়নি। এক গ্রামবাসীর কথায় ওঝার কাছে গেলে, সে পড়শি ওই বিধবাকে ডাইনি বলে জানায়।’’ গ্রাম সূত্রে খবর, বুধবার রাতেই গ্রামে ষোলোআনার বৈঠকে ফরমান জারি হয়, ওই তরুণীর চিকিৎসার যাবতীয় খরচ অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ওই বিধবাকেই বহন করতে হবে।

কিন্তু তিনি রাজি হননি। এরপরেই বৃহস্পতিবার রাতে ওই মহিলার বাড়িতে হামলা হয়। বিপদের আশঙ্কায় আগেই বাড়ি থেকে পালান ওই মহিলা। তাঁকে না পেয়ে বাসিন্দারা তাঁর বছর বাষট্টির বৃদ্ধা মা ও দুই দাদাকে বাড়িতেই বেঁধে রাখে। ওই মহিলার বাবা অসুস্থ হওয়ায় তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

এলাকার বাসিন্দা সিপিএমের মানবাজার ২ জোনাল কমিটির সম্পাদক বৈদ্যনাথ সোরেন বলেন, ‘‘আমি রাতেই ওই বাড়িতে গিয়েছিলাম। সেখানে মহিলাদের সংখ্যা বেশি ছিল। উত্তেজিত মহিলারা কোনও কথাই শুনতে রাজি ছিলেন না। এমনকী আমাকেও তারা খানিকক্ষণ আটকে রাখে।’’

শুক্রবার সকালেও গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বিশাল পুলিশ কর্মীদের উপস্থিতিতেও গ্রামের মধ্যে কিছু পুরুষ ও মহিলা রীতি মতো মারমুখী মেজাজে ঘুরে বেরাচ্ছেন। কেন এমন নির্যাতন করা হল? এক মহিলার ঝাঁঝালো জবাব, ‘‘ডাইনি বলেই তো ভয়ে ও পালিয়ে গিয়েছে। সে জন্যই ওর বাড়ির লোকেদের আটকে রেখেছিলাম। কাউকে বেঁধে রাখা বা মারধর করা হয়নি।’’ যদিও নির্যাতিতদের হাতে দড়ি বাঁধার দাগ স্পষ্ট। তাঁরা অবশ্য কোনও মন্তব্য করতে চাননি।

তবে ওই অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ফোনে অভিযোগ করেন, ‘‘আমার এতদিনকার চেনা লোকজনই হঠাৎ মিথ্যা ডাইনি অপবাদ দিয়ে কেমন পাল্টে গিয়েছে। তাই বৃহস্পতিবার রাতে ওরা দল বেঁধে আমাদের বাড়িতে চড়াও হতেই ভয়ে পালিয়ে যাই।’’

খবর পেয়ে রাতেই বোরো থানার পুলিশ কর্মীদের নিয়ে পুলিশ আধিকারিকেরা ওই গ্রামে যান। কিন্তু গ্রামবাসীদের বাধায় ওই তিন জনের কাছে পৌঁছতে পারেনি। এ দিন সকালে গ্রামে যায় মানবাজার, পুঞ্চা, বান্দোয়ান, বরাবাজার থানার পুলিশ।

সকাল থেকে গ্রামে আসে বিজ্ঞান মঞ্চ, আদিবাসী ডক্টর্স ফোরাম, মাঝি পারগনা মহল। মাঝি পারগানা মহলের পুরুলিয়ার আহ্বায়ক রতনলাল হাঁসদা, সাঁওতালি সাহিত্যিক কলেন্দ্রনাথ মান্ডিরা গ্রাম বাসিন্দাদের বোঝান, ‘‘ওই তরুণীর প্রকৃত চিকিৎসা করানো দরকার। ওর অসুখের জন্য কেউ দায়ি নয়। কয়েকজনের ভুল ধারণার জন্যে আমাদের সমাজের বদনাম হচ্ছে।’’ এরপরেই বাঁধন খোলা হয়। পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের জেলা সম্পাদক নয়ন মুখোপাধ্যায় গ্রামবাসীদের জানান, ডাইনি বলে কিছু হয় না। ওই তরুণীর ঠিক মতো চিকিৎসা না হওয়ায় তিনি বারবার অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।

দুপুরের দিকে ওই তরুণীকে পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পুরুলিয়ার জেলাশাসক অলকেশপ্রসাদ রায় বলেন, ‘‘ওই ছাত্রীর চিকিৎসা করানো হচ্ছে। তবে কুসংস্কার মুক্ত সমাজ গড়তে সচেতনতার কাজে আরও জোর দেওয়া হবে।’’

পুলিশ জানিয়েছে, কোনও অভিযোগ দায়ের হয়নি। তবে গ্রামে যাতে নতুন করে অশান্তি না ছড়ায়, সে জন্য পুলিশের টহল রয়েছে।

Superstition Beaten Elderly Lady ডাইনি
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy