Advertisement
E-Paper

‘কিছু লাগবে না, সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে’

দুপুর ১টা। তারাপীঠের মুণ্ডমালিনীতলা এলাকা। রাস্তা ধরে এগোতেই পিছন থেকে ডাকটা এল— ‘‘ও দাদা, রুম লাগবে?’’ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পেলাম বছর চল্লিশের এক যুবক। মুখ থেকে ভসভসে গন্ধ ভেসে আসছে। জবাব দিলাম, ‘‘লাগবে, কিন্তু আমাদের কাছে কোনও পরিচয়পত্র নেই।’’

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৬ ০১:৩১
এই লজেই ভুয়ো পরিচয় দিয়ে ঠাই নিয়েছিল সৌরভ খুনে অভিযুক্ত শ্যামল কর্মকার। মঙ্গলবার তারাপীঠে ছবিটি তুলেছেন সব্যসাচী ইসলাম।

এই লজেই ভুয়ো পরিচয় দিয়ে ঠাই নিয়েছিল সৌরভ খুনে অভিযুক্ত শ্যামল কর্মকার। মঙ্গলবার তারাপীঠে ছবিটি তুলেছেন সব্যসাচী ইসলাম।

দুপুর ১টা।

তারাপীঠের মুণ্ডমালিনীতলা এলাকা। রাস্তা ধরে এগোতেই পিছন থেকে ডাকটা এল— ‘‘ও দাদা, রুম লাগবে?’’ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পেলাম বছর চল্লিশের এক যুবক। মুখ থেকে ভসভসে গন্ধ ভেসে আসছে। জবাব দিলাম, ‘‘লাগবে, কিন্তু আমাদের কাছে কোনও পরিচয়পত্র নেই।’’ আগন্তুক দু’জনকে আপাদমস্তক মেপে নিয়ে হাতে একটি লজের কার্ড এগিয়ে দিল সেই যুবক। হেসে বলল, ‘‘কিচ্ছু লাগবে না। ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’’

বিস্ময়ের এখানেই বাকি ছিল না। ওই যুবক যে লজের সামনে এসে দাঁড়ালেন, তার একটির পরেই সেই বহুচর্চিত লজ । যেখানে আশ্রয় নিয়েছিল বামনগাছির প্রতিবাদী কলেজছাত্র সৌরভ চৌধুরী (২২) খুনের মূল অভিযুক্ত শ্যামল কর্মকার এবং তার দুই সাগরেদ রতন দাস (তোতা) ও শিশির মুখোপাধ্যায় ওরফে সন্তু পুরুত। যেখানে নিয়ম-বিরুদ্ধ ভাবে কেবল শিশিরের পরিচয়পত্র দেখেই বাকিদেরও ঘর ভাড়া দিয়েছিল ওই লজ কর্তৃপক্ষ। মঙ্গলবার শ্যামল-সহ আট জনকে ফাঁসির সাজা শুনিয়েছে আদালত। রতন ও শিশিরের হয়েছে ৫ বছরের জেল। কিন্তু, প্রায় দু’বছর কেটে গেলেও হোটেল-লজের ঘরভাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে তারাপীঠের ছবিটা যে আদৌ পাল্টায়নি, পদে পদে তারই যেন প্রমাণ মিলছে।

ঘটনার পরে ২০১৪ সালের ৫ জুলাই বামগাছিতে রেললাইনে ক্ষতবিক্ষত দেহ উদ্ধার হয় বিরাটি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সৌরভের। ঘটনার পর থেকেই পলাতক ছিল মূল অভিযুক্ত শ্যামল। ঘটনার দু’দিন পরে সোমবার মাথার চুল ও সাধের দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে রতন ও শিশিরকে নিয়ে শ্যামল তারাপীঠের ওই লজে আশ্রয় নিয়েছিল। তিন জনের মধ্যে মাত্র এক জনের (শিবির) নাম-ঠিকানা সচিত্র ভোটার কার্ডের ফোটোকপি জমা নিয়েছিল লজ কর্তৃপক্ষ। শ্যামল ও রতন ভুয়ো নাম দিয়েছিল। লজের রেজিস্টারে ওই দু’জনের নাম লেখা হয়েছিল তারক কুণ্ডু ও কার্তিক মণ্ডল। দু’জনের কারও ঠিকানাই দেওয়া হয়নি। ওই দু’জনের সঙ্গে তৃতীয় নামটি ছিল শিশির মুখোপাধ্যায়ের। সঙ্গে কলকাতার ঠিকানা (৫৩/৬ চাউলপট্টি রোড, বেলেঘাটা)। পরের দিন রাত ১০টা নাগাদ লজ ছেড়ে দেওয়ার কথা শ্যামলরা জানিয়েছিল। রামপুরহাট স্টেশন থেকে গৌড় এক্সপ্রেস ধরার জন্য ৮ জুলাই রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ ঘর ছেড়ে দেয় তারা। জলপাইগুড়িতে এক পরিচিতের বাড়িতে পালিয়ে যাওয়ার ছক কষেছিল তারা। কিন্তু, ট্রেন ধরার আগেই রামপুরহাট স্টেশনে ঢোকার মুখে পুলিশের জালে ধরা পড়ে শ্যামল।

নিয়ম অনুযায়ী, বোর্ডারদের প্রত্যেকের নাম-পরিচয়পত্র খতিয়ে দেখে প্রতিলিপি রেখে ঘরভাড়া দেওয়ার কথা। কিন্তু তারাপীঠে একটা বড় অংশের হোটেল-লজ সেই নিয়ম পালন করে না বলেই অভিযোগ। সৌরভ-হত্যার সাজা ঘোষণার দিনও সেই ট্র্যাডিশনের খোঁজ তারাপীঠে মিলেছে। এ দিন যে লজে পরিচয়পত্র ছাড়াই ‘ব্যবস্থা’ করে দেওয়ার প্রস্তাব দিতে শোনা গেল ওই যুবককে, তার মালিক আবার তৃণমূলের এক নেতা। লজ মালিকদের একাংশও মানছেন, তারাপীঠের লজ-হোটেলের প্রায় ৫০ শতাংশই এখনও পরিচয়পত্র ছাড়া লজ ভাড়া দিচ্ছে। তাঁদের কথায়, ‘‘তারাপীঠ দর্শনে কোনও বাস পার্টিতে যদি ৫০ জন ট্যুরিস্টও আসেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কেবলমাত্র কয়েক জনের পরিচয়পত্র নিয়ে সকলকে ঘরভাড়া দিয়ে দেওয়া হয়।’’ কেন? মালিকেরা জানাচ্ছেন, তারাপীঠে কৌশিকী অমাবস্যা, চতুর্দশী তিথি, পৌষ মাস ছাড়া প্রতি সপ্তাহের মঙ্গল ও শনিবার ছাড়া ভিড় কম হয়। এ দিকে, লজের সংখ্যা বেশি হয়ে যাওয়ায় অনেকেই কম্পিটিশনের বাজারে দর্শনার্থী পেয়ে গেলে মওকা বুঝে পরিচয়পত্র না দেখেই ঘরভাড়া দিয়ে দেন। আর তার ফাঁক গলেই শ্যামলের মতো অপরাধীরা তারাপীঠে সহজে ডেরা বাঁধে।

যদিও মুখ্যমন্ত্রী ঢাকঢোল পিটিয়ে তারাপীঠ-রামপুরহাট উন্নয়ন পর্ষদ গড়ার সময়ে এলাকার উন্নয়নের পাশাপাশি নিরাপত্তা বাড়ানোর দিকটি দেখার ব্যাপারেও আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। সেই পর্ষদের ভাইস চেয়ারম্যানের বসানো হয়েছে তারাপীঠ লজ মালিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি তথা স্থানীয় তৃণমূল নেতা সুকুমার মুখোপাধ্যায়কে। সেই পর্ষদে স্থান পেয়েছেন তারাপীঠ লজ মালিক অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক দেবীপ্রসাদ মণ্ডলও। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই ঘরভাড়া দেওয়ার নিয়ম ঠিক ভাবে পালন না করার ক্ষেত্রে প্রশ্নের মুখে তাঁদের ভূমিকাও। যদিও এ ব্যাপারে পর্ষদ বা অ্যাসোসিয়েশন, দু’পক্ষই কার্যত হাত তুলে নিয়েছে। সুকুমারবাবুর সাফাই, ‘‘নির্দেশ আছে, প্রত্যেকের ভোটার কার্ড নিয়ে ঘরভাড়া দিতে হবে। এখন কেউ যদি তা পালন না করে, তার দায় লজ মালিক অ্যাসোসিয়েশন নেবে না। তাকে নিজের জ্বালা নিজেকে সইতে হবে।’’ একই সুরে পর্ষদের এগজিকিউটিভ অফিসার তথা অতিরিক্ত জেলাশাসক (উন্নয়ন) উমাশঙ্কর এস বলেন, ‘‘এগুলো পুলিশ, এসডিও-র দেখার কথা। আমার দায়িত্ব খালি তারাপীঠে উন্নয়নমূলক কাজ করা।’’

এ দিকে, এসডিও (রামপুরহাট) সুপ্রিয় দাসের বক্তব্য, প্রত্যেকটি লজ মালিককে নির্দেশ দেওয়া আছে, বোর্ডারদের পরিচয়পত্র প্রত্যেক দিন সংশ্লিষ্ট থানায় জমা দিতে হবে। পুলিশ সেগুলো খতিয়ে দেখবে। কেউ সেই নিয়ম ভাঙলে, তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন এসডিপিও কমল বৈরাগ্যও।

Tarapith Identity card not necessary room booking
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy