Advertisement
E-Paper

আসা হল না দাদার বিয়েতে

পুরুলিয়া জেলা পরিষদের সামনের খাবারের দোকানটা বন্ধ করে বাড়ি চলে গিয়েছিলেন শুভঙ্কর। সন্ধ্যায় আবার একটা ফোন। ভাই আর নেই।

প্রশান্ত পাল

শেষ আপডেট: ৩০ মার্চ ২০১৮ ০০:৩৩
শোক: পুরুলিয়া শহরের বাড়িতে শুভজিতের বাবা-মা। ছবি: সুজিত মাহাতো

শোক: পুরুলিয়া শহরের বাড়িতে শুভজিতের বাবা-মা। ছবি: সুজিত মাহাতো

মঙ্গলবার দুপুরে একটা ফোন এসেছিল শুভঙ্করের মোবাইলে। জেনেছিলেন, ভাই শুভজিৎ অ্যান্টার্কটিকায় দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত।

পুরুলিয়া জেলা পরিষদের সামনের খাবারের দোকানটা বন্ধ করে বাড়ি চলে গিয়েছিলেন শুভঙ্কর। সন্ধ্যায় আবার একটা ফোন। ভাই আর নেই।

শুভজিৎ সেন। মানভূম ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউট থেকে উচ্চমাধ্যমিক। পুরুলিয়ার জেকে কলেজ থেকে ভূতত্ত্বে স্নাতক। স্নাতকোত্তর ভূবনেশ্বর আইআইটি থেকে। গত বছর। তার পরেই অ্যান্টার্কটিকা অভিযানে সামিল হওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের ভূবিজ্ঞান মন্ত্রকের অধীন ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর অ্যান্টার্কটিক অ্যান্ড ওশান রিসার্চ’-এ গবেষণা প্রকল্প জমা করেছিলেন। ৩৭তম ‘ইন্ডিয়ান সাইন্টিফিক এক্সপেডিশন টু অ্যান্টার্কটিকা’ (আইএসইএ)-তে ছাত্র প্রতিনিধি হিসাবে যোগ দেওয়ার সুযোগ পান।

ন্যাশনাল সেন্টার ফর অ্যান্টার্কটিক অ্যান্ড ওশান রিসার্চ-এর ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, সোমবার কাজ করার সময়ে শুভজিৎ দুর্ঘটনার কবলে পড়েন। দ্রুত উদ্ধার করে ভেসেলে নিয়ে আসা হয় তাঁকে। চিকিৎসকদের অনেক চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা করতে পারেননি বলে দাবি করা হয়েছে। গবেষণা কেন্দ্র ‘মৈত্রী’-র পথে মৃত্যু হয় তাঁর।

খবরটা পাওয়ার পর থেকে শুভঙ্কর আর দোকান খোলেননি।

বাড়িতে সবাই জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ব্যাপারটা কী? কী হয়েছে? খদ্দের হচ্ছে না বলে এড়িয়ে যাচ্ছিলেন শুভঙ্কর। বৃহস্পতিবার বলছিলেন, ‘‘কিছুতেই বলে উঠতে পারছিলাম না। কিছু দিন আগেই বাবার গল ব্লাডারে অস্ত্রোপচার হয়েছে। মা-র শরীরটাও ভাল যাচ্ছে না।’’ কোনও রকমে সত্যিটা পাথর চাপা দিয়ে কাটিয়ে ফেলেছিলেন পুরো একটা দিন। বাঁধ ভাঙে বৃহস্পতিবার।

শুভজিৎ আর নেই। এই এপ্রিলের ১৩ তারিখ পঁচিশে পা দেওয়ার কথা ছিল তাঁর। তার আগেই মেরুপ্রদেশে শেষ হয়ে গেল সব। শোনার পরে পুরুলিয়া শহরের সাত নম্বর ওয়ার্ডের ভুইঁঞা পাড়ার বাড়ির দোতলার ঘরে নিজেকে প্রায় বন্দি করে ফেলেছেন শুভজিতের বাবা দিলীপ সেন। মা মুক্তাদেবী বলছেন, ‘‘অনেক লড়াই করে পড়াশোনা করেছে। বিদেশ বিভুঁইয়ে যেতে হয়েছে। কখনও আমরা ধরে রাখিনি। এ বার মনে হয়েছিল, অনেকটা দূর। কেন যে আটকালাম না!’’

গত বছর কালীপুজোর সময়ে পুরুলিয়া থেকে পা বাড়িয়েছিলেন অ্যান্টার্কটিকার উদ্দেশে। বিয়ে হয়ে বোন চলে গিয়েছে শ্বশুরবাড়ি। বাড়িতে বাবা, মা আর দাদা। ইচ্ছে হলেই যে ছেলের গলা শুনতে পাবেন, সেই উপায় ছিল না তাঁদের। স্যাটেলাইট ফোন থেকে বাড়িতে মাঝে মধ্যে ফোন করতেন শুভজিৎ।

পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, শুভজিতের শেষ ফোন এসেছিল দিন পাঁচেক আগে। এপ্রিলের শেষে দাদার বিয়ে। আগেই হওয়ার কথা ছিল। বাড়ির ছোট ছেলের ফেরার অপেক্ষায় পিছিয়ে দেওয়া হয়। শুভজিৎ ফোনে বলেছিলেন, কাজ প্রায় শেষ। দাদার বিয়ের আগে ঠিক চলে আসবেন।

ফেরা আর হল না। কলেজে পড়ার সময়ে চুটিয়ে রাজনীতি করেছেন শুভজিৎ। এখনও তাঁর জনপ্রিয়তার কথা বলেন অনেকে। অভিযাত্রী দলের সবার মনও জয় করে নিয়েছিলেন ক’দিনেই। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, প্রাণোচ্ছল তরুণটির অন্যদের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলার কথা। ছোট-বড় প্রয়োজনে পাশে এসে দাঁড়ানোর কথা।

গল্পপ্রিয়, হাসিখুশি শুভজিতের পড়শি যুবক বিধান সেন বলেন, ‘‘আমার সঙ্গে শেষ যখন কথা হয়েছিল, তখন ও কেপটাউন থেকে অ্যান্টার্কটিকা রওনা হচ্ছে। বলেছিল এপ্রিলে ফিরে গল্প হবে।’’ ঘনিষ্ঠ বন্ধু মনোজিৎ সেন বলছেন, ‘‘আমরা এখন কাকু কাকিমার সামনে কী ভাবে গিয়ে দাঁড়াব বুঝে উঠতে পারছি না।’’

শুভজিতের মামা নিতাই কুণ্ডু বলেন, ‘‘যাওয়ার আগে দেখা করতে এসেছিল। খুশিতে চোখমুখ ঝলমল করছিল। সমস্ত স্বপ্ন এক লহমায় মাটিতে মিলিয়ে গেল।’’

Boy Dead Father
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy